Sunday, July 26, 2009

[Yoga] |ইয়োগা: সুদেহী মনের খোঁজে । ৯৪। নিরাময়: মেদ-স্থূলতা।


|ইয়োগা: সুদেহী মনের খোঁজে । ৯৪। নিরাময়: মেদ-স্থূলতা।
রণদীপম বসু

# (০৪) মেদ-স্থূলতা (Fatness, Corpulence | Med-Sthulota):

চর্বি হচ্ছে সঞ্চিত খাদ্য। চর্বি বা মেদ আমাদের দেহের জন্য অত্যাবশ্যক, তবে তা পরিমিত মাত্রায়। চর্বি না থাকলে দেহের লাবণ্য, নমনীয়তা, নড়াচড়া, সাবলীল চলাফেরা এবং প্রয়োজনীয় উষ্ণতা ধরে রাখা কিছুতেই সম্ভব হতো না। দেহের শতকরা প্রায় ৮০ ভাগ চর্বি চামড়ার নিচে থেকে এই কাজগুলো করে যায়। বাকি চর্বিগুলো অস্থি-সন্ধি ও মাংশপেশীর সাথে মিশে থাকে। যখনি ক্ষুধার্ত হই আমরা, কোন কারণে খাদ্যগ্রহণে অসমর্থ হলে আমাদের এই সঞ্চিত চর্বি ক্ষয় হয়ে দেহযন্ত্রগুলোকে চালু রাখতে শক্তি সরবরাহ করে দেহের ক্ষতিপূরণ করে থাকে। এজন্যেই আমাদের দেহযন্ত্রগুলো সচল রাখতে কিছু চর্বি সঞ্চিত থাকা প্রয়োজন।

কিন্তু দেহে সঞ্চিত চর্বি মাত্রাতিরিক্ত হয়ে গেলে এবং এই চর্বির সাথে যদি মাংসও বৃদ্ধি পেতে থাকে, তাহলে তা দেহের জন্য সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। মেদবহুল দেহীদের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা নষ্ট হয়ে দেহের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাও বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। ফলে প্রায়ই এরা উচ্চ-রক্তচাপ তথা হৃদরোগ, ডায়াবেটিস বা বহুমূত্রসহ নানান রোগের শিকারে পরিণত হয়।


রোগের লক্ষণ:
স্থূলতা বৃদ্ধির প্রাথমিক লক্ষণই হচ্ছে নির্ধারিত মাত্রাসীমার চেয়ে ওজন বেড়ে যাওয়া। এই ওজন যতই বাড়বে, তা কমানো ততই কঠিন হয়ে পড়ে। তাই শারীরিক উচ্চতা ও দেহের গড়ন অনুযায়ী মানসম্মত হারের মধ্যেই ওজন সীমাবদ্ধ থাকা উচিত। এর চেয়ে ওজন ১০% বৃদ্ধি পেলেই তাকে মেদবৃদ্ধি বা স্থূলতা রোগ হিসেবে চিহ্ণিত করা যেতে পারে। সাধারণ ক্ষেত্রে ওজনের এই মানসম্মত হার হবে এরকম-

উচ্চতা = ওজন (পুরুষ)- ওজন (স্ত্রী)
৬০ ইঞ্চি = পুরুষ[৫০ থেকে ৫৬ কেজি]- স্ত্রী[৪৫ থেকে ৫২ কেজি]
৬৩ ইঞ্চি = পুরুষ[৫৩ থেকে ৫৯ কেজি]- স্ত্রী[৪৯ থেকে ৫৬ কেজি]
৬৫ ইঞ্চি = পুরুষ[৫৭ থেকে ৬৩ কেজি]- স্ত্রী[৫২ থেকে ৫৯ কেজি]
৬৮ ইঞ্চি = পুরুষ[৬৩ থেকে ৬৯ কেজি]- স্ত্রী[৫৯ থেকে ৬৫ কেজি]
৭০ ইঞ্চি = পুরুষ[৬৬ থেকে ৭৩ কেজি]- স্ত্রী[৬২ থেকে ৬৯ কেজি]
এখানে ওজন দেখানোর ক্ষেত্রে প্রথমটি ছোট গড়নের এবং দ্বিতীয়টি বড় গড়নের পুরুষ ও স্ত্রীর মানসম্মত ওজন দেখানো হয়েছে। মাঝারি গড়নের পুরুষ বা স্ত্রীর ক্ষেত্রে দুটোর মাঝামাঝি ওজনকে বিবেচনায় নিতে হবে। যেমন ৬০ ইঞ্চি উচ্চতা বিশিষ্ট পুরুষের দেহের মানসম্মত ওজন হবে ছোট গড়নের ক্ষেত্রে ৫০ কেজি, এবং বড় গড়নের ক্ষেত্রে ৫৬ কেজি। অতএব মাঝারি গড়নের ক্ষেত্রে ওজন হবে ৫৩ কেজি।

রোগের কারণ:
দেহে নানা কারণে চর্বি জমতে পারে। তবে স্থূল বা মোটা হওয়ার জন্য সাধারণত তিনটি কারণকে প্রধান হিসেবে বিবেচনা করা হয়। (১) বংশধারা, (২) পরিপাকযন্ত্র ও গ্রন্থিগুলোর নিষ্ক্রিয়তা বা সঠিকভাবে কাজ না করা এবং (৩) স্বাস্থ্য রক্ষায় সাধারণ নিয়ম না মানা।


পিতৃ ও মাতৃ-কুলে স্থূলত্বের ধারা বজায় থাকলে কারো কারো ক্ষেত্রে বংশানুক্রমে এই ধারা বাহিত হতে পারে। তবে তা সংখ্যায় কম এবং স্বাস্থ্যরক্ষার নিয়ম-বিধি কঠোরভাবে পালন করলে তা পরিমিত পর্যায়ে সীমাবদ্ধ রাখা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব।
দ্বিতীয়ত আমাদের দেহস্থিত প্রধান গ্রন্থিগুলো যেমন পিটুইটারী গ্রন্থি, থাইরয়েড গ্রন্থি ইত্যাদি সঠিকভাবে কাজ না করলে বা নিষ্ক্রিয় হলে স্থূলতা দেখা দেয়। থাইরয়েড গ্রন্থি হতে যে বিশেষ হরমোন নিসৃত হয় তা অল্পমাত্রায় ক্ষরিত হলে মানুষ স্থূল হতে থাকে এবং অধিকমাত্রার ক্ষরণে কৃশ হয়ে যায়। প্রয়োজনীয় হরমোন পরীক্ষায় তা নিশ্চিত হওয়া গেলে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের সহায়তায় সুনির্দিষ্ট ঔষধ সেবনের মাধ্যমে এই তারতম্যের নিরসন ঘটিয়ে রোগটিকে নিয়ন্ত্রণ করা আজকাল অসম্ভব কিছু নয়।

বর্তমানে সিংহভাগ ক্ষেত্রেই মেদবহুল স্থূল হবার প্রধান কারণ হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধির সাধারণ নিয়ম মেনে না চলা। কায়িক শ্রম-বিমুখতা, অতিভোজন, অধিক পরিমাণে আমিষ ও অতিরিক্ত চর্বিজাতীয় খাদ্যগ্রহণ, ন্যূনতম ব্যায়ামের অভাব ইত্যাদি কারণে এ রোগ হয়ে থাকে। স্থূলদেহী বা মেদরোগীরা প্রায়ক্ষেত্রেই ভোজনবিলাসী হয়ে থাকে। আর এই ভোজনবিলাসের কারণে বাছ-বিচারহীন এসব চর্বিজাত, অতিরিক্ত স্নেহ ও শর্করাজাতীয় খাদ্যগুণ সমৃদ্ধ ফাস্টফুডের দিকে আকর্ষণ বাড়তে থাকা এবং সে তুলনায় কায়িক পরিশ্রম না থাকায় রোগটিও উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকে।


রোগ নিরাময়:
নিয়মিত ব্যায়াম অভ্যাসের সাথে সাথে মেদ রোগীদের আহারে-বিহারে খুবই সংযমী হওয়া বিশেষ প্রয়োজন। খাওয়া-দাওয়ায় সংযমী হলেই সাধারণতঃ স্থূলতা জয় করা যায়। সকালে অল্প পরিমাণে চিড়া, মুড়ি, খই বা সেঁকা রুটিজাতীয় যেকোন ধরনের খাবার এবং সেই সাথে চিনি ছাড়া এক কাপ পাতলা দুধ এক চামচ মধুর সাথে মিশিয়ে খাওয়া যেতে পারে। দুপুরে ভাত, ডাল, শাকসবজি, তরকারি, মাছ প্রভৃতি এবং শেষ পাতে টক খাওয়া যেতে পারে। খাবার অবশ্যই পরিমিত পরিমাণে হবে। তরকারি ও শাকসবজির পরিমাণ বেশি হওয়া উচিত। তবে চর্বি বা অধিক মশলাযুক্ত খাবার না খাওয়াটাই যুক্তিযুক্ত। কাঁচা ঘি, মাখন বা এই জাতীয় কোন খাবার কিছুতেই খাওয়া উচিত হবে না। একান্তই ক্ষুধা পেলে বিকেলে খুব হালকা সহজ নাস্তা খাওয়া যেতে পারে। রাতে দু-একটা আটার রুটি ডাল বা সবজিসহ খাওয়া যেতে পারে। তবে তা বেশি রাত করে নয়।

নিয়মমাফিক উপবাস শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। সপ্তাহে এক বেলা কিংবা পনের দিনে একদিন সম্পূর্ণ উপবাস স্থূলতা কমাতে খুব সহায়তা করে থাকে। উপবাসের সময় লেবুর রস মিশিয়ে প্রচুর পরিমাণে পানি খেতে হবে।


এইসব খাদ্যাভ্যাস পালনের পাশাপাশি নিয়মিত ব্যায়ামের কোন বিকল্প নেই। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে লেবুর রস মিশিয়ে এক গ্লাস পানি পান করে প্রথমে কিছু খালি হাতে ব্যায়াম ও সূর্য-নমস্কার ব্যায়াম করে ২/৩ মিনিট শবাসন করতে হবে। এরপর পবন-মুক্তাসন, পদ-হস্তাসন, অর্ধ-চক্রাসন বা অর্ধ-চন্দ্রাসন, ত্রিকোণাসন, উত্থিত-পদাসন অভ্যাস করতে হবে। এতে রোগ একটু প্রশমিত হলে এই সাথে মৎস্যাসনসর্বাঙ্গাসন করলে আরো ভালো ফলাফল পাওয়া যায়। এভাবে আরো কিছুদিন অভ্যাসের পর উষ্ট্রাসন, ধনুরাসন, হলাসন প্রভৃতি আসন চর্চা করা যেতে পারে। তবে কখনোই একসাথে ছয় থেকে আটটি আসনের বেশি অভ্যাস করা উচিত নয়।

বিকেলে আধঘণ্টা থেকে একঘণ্টা দ্রুত হাঁটা বা দৌঁড়ানো এবং সুযোগ থাকলে আধঘণ্টাখানেক সাঁতার কাটা গেলে বিশেষভাবে ফলপ্রসূ হবে। আর রাত্রে ঘুমানোর পূর্বে পনের মিনিট বজ্রাসন করা আবশ্যক।
তবে নিষিদ্ধ প্রচেষ্টা হিসেবে দিবানিদ্রা কোনভাবেই বাঞ্ছনীয় নয়।
[Images: from internet]

(চলবে...)

পর্ব: [৯৩][**][৯৫]

Saturday, July 25, 2009

[Yoga] ইয়োগা: সুদেহী মনের খোঁজে । ৯৩। নিরাময়: আমাশয়।


|ইয়োগা: সুদেহী মনের খোঁজে । ৯৩। নিরাময়: আমাশয়।
রণদীপম বসু

# (০৩) আমাশয় (Dysentery | Amashoy):

এটা জীবাণু ঘটিত এক ধরনের সংক্রামিত রোগ। সাধারণ ক্ষেত্রে এই রোগ জীবনসংশয়কারী না হলেও খুব বিরক্তিকর ও যন্ত্রণাদায়ক। এই রোগে একবার আক্রান্ত হলে ভোগান্তি থেকে সহজে নিরাময় হওয়া যায় না। ক্রনিক পর্যায়ে চলে গেলে দেহে অনেক জটিলতার সৃষ্টি করে এবং রোগী নিজেই এ রোগের বাহক হিসেবে কাজ করে।
দু'ধরনের আমাশয়ের কথা শোনা যায়। অ্যামিবা জাতীয এক ধরনের জীবাণু থেকে অ্যামিবিক আমাশয় এবং সিগেলা জাতীয় ব্যাসিলাস থেকে ব্যাসিলারি আমাশয় হয়ে থাকে। জীবাণুগুলো পেটে গিয়ে দ্রুত বংশবৃদ্ধি ঘটাতে থাকলে ক্ষুদ্রান্ত্রে ও বৃহদন্ত্রে প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং অন্ত্রের ঝিল্লীতে ঘা বা ক্ষত সৃষ্টি করে। এই ঘা বা ক্ষত বৃহদন্ত্রে হলে তাকে বলে কোলাইটিস (Colitis), আর প্রদাহ ক্ষুদ্রান্ত্রে হলে তাকে অন্ত্র-প্রদাহ বা ইটারাইটিস (Eteritis) বলে। এই ঘা বা ক্ষতজনিত প্রদাহ দুই অন্ত্রেই হতে পারে। তাকে বলে এন্টারোকোলাইটিস (Enterocolitis)।

রোগের কারণ:
পানি, বাতাস, মশা, মাছি ও খাবারের মাধ্যমেই সাধারণত এই রোগ সংক্রামিত হয়ে থাকে। গরম ও নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলে এ রোগের প্রকোপ বেশি হয়ে থাকে।


রোগের লক্ষণ:
প্রাথমিক অবস্থায় এ রোগের লক্ষণগুলো হচ্ছে- কয়েকদিন আগে থেকে পেটে অস্বস্তি ও ভার ভার বোধ হওয়া। কোন কোন ক্ষেত্রে কোষ্ঠকাঠিন্য এবং তারপরে উদরাময় দেখা দেয়। পায়খানার পূর্বে নাভির চারপাশে ও তলপেটে ব্যথা অনুভূত হয়। পেট কামড়াতে থাকে এবং বার বার পায়খানার বেগ হয়। কিন্তু পায়খানা খুব অল্পই হয়। পায়খানা দুর্গন্ধযুক্ত হয় এবং পায়খানার পরেও ব্যথা বা পেট কামড়ানো কিছুক্ষণ থাকে।
পায়খানা হলে প্রথমে কাদা কাদা এবং পরে পায়খানার সাথে কফ বা মিউকাস মিশ্রিত অল্প অল্প হলদে, সবুজ, কালো মল নির্গত হতে থাকে। জীবাণু দ্বারা অন্ত্রের ঝিল্লী ক্ষত-বিক্ষত হলে রক্তস্রাবের কারণে পায়খানা লালচে হয়ে যায়। মলের সাথে রক্ত নির্গত হলে তখন এ রোগকে বলা হয় রক্ত-আমাশয় (Blood-dysentery)।
অনেক ক্ষেত্রে পেটে বায়ু জমে এবং দেহের তাপ বৃদ্ধি পেয়ে অল্প জ্বরও আসতে পারে।


রোগ নিরাময়:
দ্রুত বংশ বৃদ্ধিক্ষম বহিঃস্থ জীবাণু দ্বারা আক্রান্তের কারণে এই আমাশয় রোগ সৃষ্টি হয বলে রোগগ্রস্ত হলে প্রথমে ঔষধের সহায়তায় যত শীঘ্র সম্ভব দেহকে জীবাণুমুক্ত করা আবশ্যক। সেই সাথে নিয়মিত যৌগিক-ব্যায়াম ও যথাযথ রোগারোগ্যের নিয়ম-কানুন পালন করলে আর আক্রমণ করতে পারে না। তবে মনে রাখতে হবে, শুধুমাত্র ঔষধে এ জাতীয় রোগ চিরতরে দূর হয় না। সুযোগ পেলেই এরা দেহে বাসা বেঁধে ফেলে। নিয়মিত ইয়োগা বা যোগ-ব্যায়াম অভ্যাসে রাখলে শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়ে সে সুযোগ আর থাকে না।

আমাশয় রোগীর পথ্যের ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। পানীয় হিসেবে লেবুর শরবত, ঘোল বা মাঠা, পাতলা বার্লি, ডাবের পানি, বেলের শরবত ইত্যাদি। খাবার হিসেবে কাঁচকলা, থানকুনি পাতা, কাঁচা পেঁপে ও জিওল মাছের ঝোল দিয়ে নরম ভাত। এছাড়া দুধের ছানা বা ছানা জাতীয় খাবার আমাশয় রোগীর জন্য বিশেষ উপকারী।


আমাশয় রোগীকে রোজ সকালে সহজ বস্তিক্রিয়া অভ্যাস করে কোষ্ঠ পরিষ্কার করা উচিত। সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে এক গ্লাস পানি পান করে পবন-মুক্তাসন, পদ-হস্তাসন, বিপরীতকরণী মুদ্রাযোগমুদ্রা অভ্যাস করা প্রয়োজন। এ সময় কোন কঠিন ব্যায়াম বা আসন করা ঠিক নয়। সকাল বিকাল খোলা জায়গায় কিছুক্ষণ পায়চারি করা যেতে পারে। রোগ প্রশমিত হয়ে এলে এই আসন ও মুদ্রাগুলোর সাথে সুবিধামতো সকালে বা বিকেলে নিয়মিত পশ্চিমোত্থানাসন, অর্ধ-কুর্মাসন, অর্ধ-চক্রাসন, মৎস্যাসনসর্বাঙ্গাসন অভ্যাস করলে শরীর সুস্থ সবল তো হবেই, আমাশয়ের মতো এমন বিরক্তিকর ও যন্ত্রণাকর রোগ থেকে চিরকাল মুক্ত থাকা যাবে।
[Images: from internet]

(চলবে...)

পর্ব: [৯২][**][৯৪]

[Yoga] ইয়োগা: সুদেহী মনের খোঁজে । ৯২। নিরাময়: অজীর্ণ ও অম্লদোষ।


|ইয়োগা: সুদেহী মনের খোঁজে । ৯২। নিরাময়: অজীর্ণ ও অম্লদোষ।
রণদীপম বসু

# (০২) অজীর্ণ ও অম্লদোষ (Indigestion, Dyspepsia and Acidity | Ojirno- Omlo):

সাধারণ ক্ষেত্রে এই রোগে মৃত্যু ঘটে না। তবে এ রোগে আক্রান্ত হলে দেহের ক্ষয়ের মাত্রা দ্রুত বৃদ্ধি পায় বলে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দ্রুত কমতে থাকে। ফলে সহজেই অন্যান্য রোগের কবলে পড়ে মৃত্যু বরণ করা সহজতর হয়। তাই প্রাথমিক অবস্থায় থেকে যাতে এই অজীর্ণ রোগ বিস্তার লাভ করতে না পারে এবং দ্রুত নিরাময় হয় যথাসাধ্য সে চেষ্টা করা উচিত।


রোগের লক্ষণ:
আক্রান্ত রোগী খাবার পর বমি বমি ভাবসহ বুকে পেটে চাপ বোধ করে। বমি হলে চাপ একটু কম মনে হয়। ক্ষুধামন্দা, আহারে অরুচি, পেটে অতিরিক্ত বায়ু-জমা, মুখে ও শ্বাসে দুর্গন্ধ, জিহ্বায় সাদা বা হলদে ময়লার স্তর জমা, তলেপট ভার হয়ে থাকা ইত্যাদি এ রোগের লক্ষণ হিসেবে বিবেচিত হয়। অজীর্ণের সাথে যারা রক্তস্বল্পতায় আক্রান্ত হয় তাদের পেটে ঘা ও ব্যথা হতে পারে। দুর্বল অন্ত্রের কারণে কোষ্ঠকাঠিন্য বা কোষ্ঠতারল্য হতেও দেখা যায়।


রোগের কারণ:
অপরিমিত বা অল্প ক্ষুধায় অধিক মাত্রায় আহার বা অতিরিক্ত তেল ঘি মশলাযুক্ত গুরুপাক খাদ্য গ্রহণ এবং কায়িক-শ্রমবিমুখতা বা পরিমিত ব্যায়ামের অভাব এই রোগের অন্যতম প্রধান কারণ। অতিরিক্ত ওষুধপ্রীতি, অধিক রাতে ভরপেট খাবার অভ্যাস, দিনের পর দিন একই ধরনের খাবার গ্রহণ, অতিরিক্ত ঘুম বা মদ্যপান, মানসিক দুঃশ্চিন্তা বা অশান্তি, এক বা একাধিক বিশেষ গ্রন্থির অক্ষমতা ইত্যাদি যে কোন কারণে অজীর্ণ রোগ হতে পারে।


রোগ নিরাময়:
সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে ১-২ গ্লাস পানি খেয়ে পবন-মুক্তাসন, পদ-হস্তাসন, ভুজঙ্গাসন, যোগমুদ্রা, মৎস্যাসন, বিপরীতকরণী মুদ্রা ও অগ্নিসার অভ্যাস করলে বিশেষভাবে উপকার পাওয়া যাবে। এছাড়া বিকেলে সহজ কিছু খালি-হাতে ব্যায়াম বা সূর্য-নমস্কার ব্যায়াম অভ্যাসের পর সর্বাঙ্গাসন, ধনুরাসন, পশ্চিমোত্থানাসন, অর্ধচক্রাসন এবং এক মিনিট উড্ডীয়ান মুদ্রা ও এক মিনিট নৌলী অভ্যাস করলে খুব দ্রুত ফলাফল পাওয়া যায়। তবে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে, ১৩/১৪ বছরের নিচে অল্পবয়েসী ছেলেমেয়েদের (মেয়েদের ঋতু সুপ্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত) উড্ডীয়ান ও নৌলী অভ্যাস করা উচিত নয়।


দীর্ঘদিন ধরে আক্রান্ত দুর্বল রোগীদের জন্য সহজপাচ্য লঘু খাবার গ্রহণ এবং দুপুর ও রাতে খাদ্য গ্রহণের পর পর কিছুক্ষণ বজ্রাসন অভ্যাস করলে ভুক্তখাদ্য সহজে পরিপাক হতে সহায়তা হবে। সকাল-বিকাল খোলা জায়গায় ভ্রমণ-প্রাণায়াম করলে সুফল পাওয়া যাবে। অজীর্ণ ও অম্ল রোগীদের জন্য সকালে ও বিকেলে শুকনো খই বা মুড়ি চমৎকার ও আদর্শ নাস্তা হিসেবে বিবেচিত হয়। আহারের সময় পানি যত কম খাওয়া হবে ততই ভালো। খাওয়ার আধঘণ্টা পর সাধারণ পানীয় জল বা ডাবের পানি খাওয়া উচিত। দিনে যত বেশি পানি খাওয়া যাবে ততই উপকার।

এভাবে নিয়মিত অভ্যাসে রোগের লক্ষণ দূর হয়ে গেলে উপরোক্ত আসনগুলোর সাথে নিয়মিত হলাসনশলভাসন অভ্যাস করলে অজীর্ণ ও অম্ল রোগ চিরতরে নির্মূল হয়ে যাবে।
[Images: from internet]

(চলবে...)

পর্ব: [৯১][**][৯৩]

[Yoga] ইয়োগা: সুদেহী মনের খোঁজে । ৯১। নিরাময়: কোষ্ঠবদ্ধতা।


|ইয়োগা: সুদেহী মনের খোঁজে । ৯১। নিরাময়: কোষ্ঠবদ্ধতা।
রণদীপম বসু

# (০১) কোষ্ঠবদ্ধতা (Constipation | Koshthoboddhota):

অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুধুমাত্র সচেতনতার অভাবেই এই রোগটার সৃষ্টি হয়ে থাকে। প্রাথমিক অবস্থায় এটাকে আমরা গ্রাহ্য করি না বলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়া এই রোগটি যতক্ষণ না কষ্টদায়ক হয়ে ওঠে ততক্ষণ আমাদের বোধোদয় হয় না। আর সুযোগে এই রোগটির শিকড় গেড়ে বসার কারণে আরো নানান রোগে ভোগার সূত্রপাত ঘটে থাকে। পুরুষের তুলনায় মেয়েদেরকে এ রোগে বেশি ভুগতে দেখা যায়।


রোগের লক্ষণ:
মলত্যাগে অনিয়ম ও মাঝে মাঝে কাদার মতো দুর্গন্ধযুক্ত মলত্যাগ। কোষ্ঠ পরিষ্কার না হওয়ায় তলপেট ভার হয়ে থাকা। মুখে ও শ্বাসে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে জিহ্বায় সাদা বা হলদে ময়লা স্তর পড়া। মাথায় ভারবোধ করা, মাথাধরা। অনিদ্রা ও আহারে অরুচি। মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়া ইত্যাদি কোষ্ঠবদ্ধতার লক্ষণ।


রোগের কারণ:
নানান কারণে কোষ্ঠবদ্ধতা হতে পারে। খাদ্য নির্বাচনে সতর্কতার অভাব, অখাদ্য গ্রহণ, তাড়াহুড়ো করে বা অন্যমনস্কভাবে খাদ্যগ্রহণ, অপরিমিত বা অল্প ক্ষুধায় পুরো আহার কিংবা অধিক রাতে ভরপেট খাবার অভ্যাস, বাসী-পচা অতিরিক্ত তেল ঘি মশলাযুক্ত আমিষ জাতীয় খাবার খাওয়া, পেটের পেশীর দুর্বলতা, কায়িক শ্রমবিমুখতা, মানসিক দুঃশ্চিন্তা বা অশান্তি, এক বা একাধিক বিশেষ গ্রন্থির অক্ষমতা ইত্যাদি। তাছাড়া প্রয়োজন মুহূর্তে মলত্যাগ না করে মল চেপে রাখলেও এ রোগ হতে পারে। আঁশযুক্ত খাবার কম খাওয়া বা পানি কম খাওয়াও এ রোগের অন্যতম কারণ।
যারা কম পানি পান করে বা কোন কারণে যাদের অধিক প্রস্রাব হয়, তাদের অন্ত্রে প্রয়োজনীয় পানি না থাকায় মল নিঃসরণ কষ্টকর হয়, ফলে কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে কোষ্ঠবদ্ধতা তৈরি হয়।
এছাড়া স্থূলদেহীরা মোটা হবার ফলে কিংবা অব্যবহারের কারণে পেটের পেশী দুর্বল হয়ে যেতে পারে। এতে করে শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় বুক ও পেটের মাঝে অবস্থিত মধ্যচ্ছদা পর্দার স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যহত হয়ে পাকস্থলীর উপর সঠিক আলোড়ন সৃষ্টি করতে না পারায় পাকস্থলী, ক্ষুদ্রান্ত ও বৃহদন্ত্রকে অধিক সক্রিয় করে তুলতে ব্যর্থ হয়। ফলে স্বাভাবিক মল নিঃসরণ সম্ভব হয় না এবং কোষ্ঠবদ্ধতা দেখা দেয়।


রোগ নিরাময়:
পরিমিত খাবারের সাথে বেশি করে শাক-সবজি ও আঁশযুক্ত খাবার খাওয়া এবং প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে। এ রোগ বেশি পুরাতন হলে সহজে সারতে চায় না। সেক্ষেত্রে উচিত রোজ রাতে শোবার আগে ৩/৪ চামচ ইসবগুলের ভূষি পানিতে ভিজিয়ে চিনিসহ পান করে ঘুমোতে যাওয়া এবং সকালে ঘুম থেকে উঠে মুখ ধুয়ে ১-২ গ্লাস ঈষদোষ্ণ পানিতে এক চামচ লবণ ও লেবুর রস মিশিয়ে পান করে কিছুক্ষণ পায়চারি করার পর কয়েকটি আসন অভ্যাস করে তারপর পায়খানায় যাওয়া। তবে পায়চারির বদলে উড্ডীয়াননৌলি মুদ্রা দুটো অভ্যাস করলে (অবশ্যই কমপক্ষে ১৩/১৪ বছর বা তার বেশি বয়সের ছেলে এবং ঋতু সুপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমন মেয়েদের ক্ষেত্রে) আরো দ্রুত ফল পাওয়া যায়।

এ ক্ষেত্রে বিশেষ ফলপ্রসূ যেসব আসন অভ্যাস করতে হয় সেগুলো হলো- পবন-মুক্তাসন, ভুজঙ্গাসন কিংবা অর্ধ-চক্রাসন, পদ-হস্তাসন, অর্ধচন্দ্রাসন, মৎস্যাসন, বিপরীতকরণী মুদ্রা বা সর্বাঙ্গাসন কিংবা হলাসন। এ ছাড়া সহজ বস্তিক্রিয়া কোষ্ঠবদ্ধতা দূর করণে অদ্বিতীয় হিসেবে ধরা হয়।
[Images: from internet]

(চলবে...)

পর্ব: [৯০][**][৯২]

Friday, July 24, 2009

[Yoga] ইয়োগা: সুদেহী মনের খোঁজে । ৯০। রোগ-নিরাময়।


ইয়োগা: সুদেহী মনের খোঁজে । ৯০। রোগ-নিরাময়।
রণদীপম বসু

# রোগ-নিরাময়ে ইয়োগা (Remedy from diseases by practising Yoga):

শরীর আছে বলেই রোগের অস্তিত্ব। তাই শরীর থাকলে রোগ-ব্যাধি থাকবেই। মাঝে মাঝেই আপনার দেহ-মন্দিরে ব্যাধির অস্পৃশ্য ছোঁয়া লাগবেই। আর এসব রোগ-বালাই’র উৎপাত থেকে দেহযন্ত্রকে নিরাপদে আগলে রাখতে হলে কিছুটা চেষ্টা-চরিত তো থাকতেই হবে।

প্রধানত দুটো কারণে দেহ রোগাক্রান্ত হয়ে থাকে-
(১) স্বাস্থ্য রক্ষার নিয়ম-কানুন না-জানা বা না-মানা’র প্রেক্ষিতে অস্বাভাবিক বা অনিয়মিত বিপাকক্রিয়াজনিত কারণ।
(২) রোগ-জীবাণু সংক্রমণ।

যে বিষয়টা আমাদের মনে রাখতে হবে, জীবাণু সংক্রমিত রোগ থেকে আরোগ্যের ক্ষেত্রে ইয়োগা বা যৌগিক-ব্যায়ামের বিশেষ কোন ক্ষমতা নেই। সে ক্ষেত্রে যথাযথ ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ সেবন আবশ্যক। তবে ইয়োগা যা করতে পারে তা হলো, নিয়মিত অভ্যাসে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এতো শক্তিশালী হয়ে উঠে যে রোগ-জীবাণু দেহে প্রবেশ করলেও ইয়োগা চর্চাকারীকে সহজে কাবু করতে পারে না। ফলে দেহ সহজে আক্রান্ত হয না।


তারপরও অধিকতর নিরাপত্তার কারণে দেহে রোগ-জীবাণু প্রবেশের উপায়গুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা উচিৎ। বিশেষ করে শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে, খাবার ও পানির মাধ্যমে, হাত-পায়ের ত্বক বা চামড়া ভেদ করে কিংবা ইঞ্জেকশানের সুইয়ের মাধ্যমে ইত্যাদি নানাভাবে দেহে রোগ-জীবাণু প্রবেশ করতে পারে। এগুলো প্রবেশ করে দেহের বিপাকক্রিয়ায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির উদ্যোগ নিলেই দেহের প্রতিরোধ ক্ষমতাবাহী রক্তের শ্বেতকণিকা তা প্রতিরোধে এগিয়ে আসে। তাই এই প্রতিরোধ ক্ষমতার উপরই মূলত দেহের রোগে আক্রান্ত হওয়া না হওয়া নির্ভর করে।

বলা হয়ে থাকে, কোন রোগই একাঙ্গিক নয়, সর্ব-দৈহিক। অর্থাৎ কোন একটি গ্রন্থি বা স্নায়ু বা যন্ত্র দুর্বল হলেই দেহে রোগের সৃষ্টি হয় না। কেননা অন্য গ্রন্থি বা স্নায়ু এই ঘাটতি পূরণ করতে প্রয়োজনীয় কর্ম সম্পাদনে এগিয়ে আসে। কিন্তু দেহের কয়েকটি গ্রন্থি বা কয়েকটি স্নায়ু বা কয়েকটি যন্ত্র কিংবা একাধিক গ্রন্থি-স্নায়ু-যন্ত্র একসাথে কম-বেশি দুর্বল ও অক্ষম হয়ে পড়লেই দেহ রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে। তাই দেহকে রোগমুক্ত করা রা রাখার জন্য বিভিন্ন গ্রন্থি, স্নায়ু বা দেহযন্ত্রাংশগুলোকে সবল ও কর্মক্ষম রাখা একান্তই আবশ্যক এবং এ জন্যেই নিয়মিত ইয়োগা চর্চার মাধ্যমে বিভিন্ন আসন ও মুদ্রা অভ্যাস করা প্রয়োজন।


স্বাস্থ্যরক্ষার নিয়ম না-জানা বা না-মানার কারণে যেসব রোগ হয়ে থাকে তার অনেকগুলোই ইয়োগা বা যৌগিক-ব্যায়াম অভ্যাসের মাধ্যমে নিরাময় হওয়া সম্ভব। তবে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে, ইয়োগার মাধ্যমে রোগ নিরাময় সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। এই সময়কাল নির্ভর করে রোগের বয়স বা প্রাচিনত্বের উপর। রোগ পুরাতন হলে দীর্ঘমেয়াদী ইয়োগা অভ্যাসের প্রয়োজন হতে পারে। প্রথমত প্রয়োজনীয় আসনগুলো আয়ত্ত করতে ব্যয়িত সময়, দ্বিতীয়ত দুর্বল অক্ষম বা বিকৃত দেহযন্ত্রের উপর আসনের প্রভাব ধীরে ধীরে কার্যকর হওয়া।

চমৎকৃত হওয়ার মতো বিষয় হলো, ইয়োগা অভ্যাসে রোগাক্রান্ত দেহযন্ত্র কেবল সুস্থই হয়ে ওঠে না, পাশাপাশি অন্যান্য দেহযন্ত্রগুলোকেও অধিকতর সুস্থ সবল ও সক্রিয় করে তুলে। ফলে দেহটা তার স্বাভাবিক সৌন্দর্য্যে মাধুর্য্যমণ্ডিত ও সুস্থ সাবলীল হয়ে ওঠে। আর এই দেহের আধারে থাকা মনটাও তার নিজস্ব স্বতঃস্ফূর্ততায় হয়ে ওঠে ঝলমলে উজ্জ্বল।

এ প্রেক্ষিতে এবার ইয়োগা অভ্যাসে নিরাময়যোগ্য কিছু রোগ ও তার প্রতিকার নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে।
[Images: from internet]

(চলবে...)

পর্ব: [৮৯][**][৯১]