Saturday, September 5, 2009

[Yoga] আপনি কেন ইয়োগা চর্চা করবেন...|


--------------------------
[Yoga] আপনি কেন ইয়োগা চর্চা করবেন...|
--------------------------
-রণদীপম বসু
-----------

জীবনের বহু বহু ব্যস্ততার মধ্যে আমাদের সময়ই হয় না নিজেকে একটু একান্ত করে দেখার। আমি কে, কী, কেন, কোথায়, কিভাবে, এ প্রশ্নগুলো করার। অথচ সামান্য এ ক’টা প্রশ্নের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে আমাদের সবটুকু রহস্য, ঠিকানা, পরিচয় এবং অস্তিত্বের অনিবার্য শর্তগুলোও। প্রশ্নের এই স্বচ্ছ আয়নায় নিয়ত বদলে যাওয়া জীবনের জলছবিগুলোই আমাদের প্রতিটা যাপন-মুহূর্ত, চলমান জীবন। অসংখ্য সমস্যার গেরোয় জট পাকিয়ে যাওয়া আমাদের জটিল জীবনযাত্রার জট খোলার চাবিটাও যে রয়ে গেছে সেখানেই, কেউ কেউ ঠিকই জানেন, আর অনেকেই তার খোঁজ রাখি না আমরা। এই প্রশ্নের সূত্র ধরেই এগুতে এগুতে অন্তর্ভেদী দার্শনিক ব্যক্তি যাঁরা, একসময় পৌঁছে যান ঠিকই জীবন ছাড়িয়ে মহাজীবনের বিপুল রহস্যের উজ্জ্বলতম দোরগোড়ায় এক অভূতপূর্ব বিস্ময় নিয়ে ! কিন্তু আমরা যারা অতি সাধারণ জন, খুব সাধারণ দেখার চোখ নিয়েও তারা কি পারি না এই অগুনতি যাপনের ভিড়ে শুধু একটিবার নিজের দিকে ফিরে তাকাতে ? যে আমাকে নিয়ে আমি নিত্যদিনের কর্মশালায় খাচ্ছি-দাচ্ছি-হাসছি-খেলছি-ঘুরছি আর মগ্ন হচ্ছি চিন্তায় বা দুঃশ্চিন্তায়, আমাদের সে ‘আমি’টা দেখতে কেমন, তা কি জানি আমরা ?

আপনি কি জানেন, ঠিক এ মুহূর্তে আপনি কেমন আছেন ? কিংবা কেমন দেখাচ্ছে আপনাকে ? আসুন না, নিজস্ব আয়নাটার সামনে খুব একান্তে দাঁড়াই একটু ! এবার নিজেকে উন্মোচিত করুন। কেমন দেখাচ্ছে আপনাকে ? ওই আয়নায় যেটা দেখছেন, সেটা আপনার দৈহিক অবয়ব। এই দেহই আমাদের ধারক, বাহক, এবং চালক। এই দেহকে ঘিরে, দেহের মাধ্যমে, এবং দেহের জন্যই আমাদের সমস্ত কর্মকাণ্ড। মন বলে যে বিমূর্ত ধারণাপিণ্ড কল্পনা করি আমরা, তাও এই দেহনির্ভর। দেহ ছাড়া মন বিকৃত, অসম্পূর্ণ, অচল। দেহের বিনাশ ঘটলে মনের আর কোন অস্তিত্ব নেই, থাকে না। এ জন্যেই প্রাচীন যোগশাস্ত্রেও উক্ত হয়- ‘শরীরমাদ্যং খলু ধর্ম সাধনম’। আপনি যা কিছুই সাধন করতে চান না কেন, এই দেহ ছাড়া গতি নেই, উপায়ও নেই। দৃশ্যমান এই দেহের অস্তিত্ব মানেই বাস্তবে আপনার অস্তিত্ব। দেহ নেই, আপনি নেই। দেহ ছাড়া কেউ থাকে না। দেহত্যাগের পরেও আপনার যে নামটা থেকে যাবে কিছুকাল আপেক্ষিক সময় জুড়ে, তাও এই দেহেরই অবদান। এই দেহ ধারণ করে দেহের মাধ্যমে করে যাওয়া কৃতকর্মই তার আপেক্ষিক স্থায়িত্বের মাধ্যমে আপনার অবর্তমানে আপনার নামটাকে বাঁচিয়ে সম্ভাব্য আপেক্ষিক স্থায়িত্ব দিতে পারে। অতএব, ভালো করে দেখুন- যে দেহটা এ মুহূর্তে ধারণ করে আছেন আপনি।

হতে পারেন আপনি নারী বা পুরুষ, এবার বলুন তো, আয়নায় আপনার যে মানবদেহের অবয়ব দেখছেন, তা কি যেমনটা হওয়ার বা থাকার কথা তেমনই আছে ? চোখ, মুখ, নাক, কান, মুখমণ্ডল, গলা, কাঁধ, বাহু, হাত, বুক, পেট, পিঠ, কোমর, উরু, পা, আঙুল, নিতম্ব, জঙ্ঘা, জননেন্দ্রিয় তথা গোটা দেহকাঠামো সম্পূর্ণ, সুঠাম, সুস্থ, সবল, নিরোগ, অবিকৃত, নিখুঁত, স্বাভাবিক সুন্দর, সক্রিয় ও সাবলীল ? এবার অন্তর্চক্ষু উন্মিলিত করুন। কল্পনা করুন আপনার দেহের ভেতরে অবস্থিত আভ্যন্তরীন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ-তন্ত্রিগুলোর কথা। মস্তিষ্ক, স্নায়ুরজ্জু, বিবিধ হরমোন গ্রন্থি, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, ধমনী, শিরা-উপশিরা, পাকস্থলি, ক্ষুদ্রান্ত্র, বৃহদন্ত্র, মাংস-পেশী-অস্থি-মজ্জা-মেরুদণ্ড, স্নায়ুতন্ত্র, শ্বাসতন্ত্র, রক্তসংবহনতন্ত্র, প্রজননতন্ত্র, বিপাকক্রিয়াদিসহ ইত্যাদি সমূহ সিস্টেম বা প্রক্রিয়া কি সুস্থ, স্বাভাবিক, সক্রিয় ও সাবলীল আছে ? আরো আছে আপনার স্বপ্ন-কল্পনা-ভাবনার বিস্ময়কর বিমূর্ত সেই জগত, যেখানে গ্রন্থিত হয় সৃজনের অবিরল স্রোত। সেও কি শারীরিক ও মানসিক বাধামুক্ত সতেজ উদ্যমে গতিমান ? এসবের উত্তর যদি ‘হাঁ’ হয়, শুধু আমি নই, প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে সবাই আপনাকে স্যলুট বা অভিবাদন জানাবে। উত্তর যদি হয় ‘না’, তাহলে দেরি নয়, এখনই ভাবুন, এক অসম্পূর্ণ অপভ্রংশ দৈহিক ও মানসিক অস্তিত্ব নিয়ে কতদূর যেতে পারেন আপনি ? আর আপনার এ চলার পথই বা কতোটা নিরাপদ, উদ্বেগহীন, ইচ্ছা-স্বাধীন ?

কথায় বলে- সুস্থ দেহ সুন্দর মন। কথাটা সর্বাংশেই সত্য। দৈহিক সুস্থতার কোন বিকল্প নেই। একটা নিরোগ সুস্থ-সুঠাম সতেজ কর্মঠ দেহের সাথে মানসিক ভ্রান্তিহীন চাপ নিরপেক্ষ সুডোল মনের রাখীবন্ধন ঘটলেই কেবল কাঙ্ক্ষিত সুন্দর পরিচ্ছন্ন জীবনের নিশ্চয়তা মেলে। কিন্তু আমাদের জীবন-বাস্তবতায় তা কতোটা অর্জন সম্ভব ?

দৈহিক সুস্থতার জন্যে প্রয়োজন সুষম খাবার গ্রহণের পাশাপাশি শারীরিক পরিশ্রম। কিন্তু পরিশ্রম পরিকল্পিত না হলে দৈহিক সৌন্দর্য ও সুস্থতা নিশ্চিত হয় না। দেহের প্রতিটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের পরিমিত সঞ্চালন ও সক্রিয়তা না হলে দেহবিন্যাস সুষম ও সুগঠিত হতে পারে না। এজন্যেই দেহের জন্য দরকার হয়ে পড়ে পরিকল্পিত শরীরচর্চা বা ব্যায়ামের। আমাদের এ নাগরিক সভ্যতায় মাঠ-ঘাট-খোলা জায়গা এখন যেভাবে ধীরে ধীরে কল্পজগতের বস্তু হয়ে ওঠছে তাতে করে শরীরচর্চার পরিসর ক্রমেই সীমিত হয়ে আসছে। কিন্তু দেহের প্রতিটা অঙ্গ প্রত্যঙ্গ পেশী হাড় অস্থিসন্ধি ও রক্তসংবহনতন্ত্রের পরিমিত সঞ্চালন ও সক্রিয়তা রক্ষার অনন্য মাধ্যম হিসেবে ইয়োগা বা যোগ-ব্যায়াম এখানে তুলনাহীন। যোগ-ব্যায়ামের বিভিন্ন আসনগুলো চর্চার জন্য আপনার ঘরের স্বল্পপরিসর মেঝে বা আপনার বিছানাটাই এক্ষেত্রে যথেষ্ট।

দেহের জ্বালানী হলো খাদ্য। তা পেলেই দেহ তার অভ্যন্তরস্থ বিশেষ বিশেষ দেহযন্ত্রের মাধ্যমে পরিবহন পরিবর্তন রূপান্তর করে নিজেকে সচল ও সবুজ সতেজ বৃক্ষের মতো পল্লবিত করে তোলে। কিন্তু খাওয়ার নামে প্রতিনিয়ত যা গিলছি আমরা তা কি আদৌ খাদ্য ? বিষাক্ত ভেজালের যুগে এই নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবে বলে মনে হয় না আর। অতএব আমাদের দেহযন্ত্রের কারখানায় বিষ থেকে অমৃত সৃজনের প্রযুক্তি যতকাল রপ্ত না হবে, ততকাল ক্রমে ক্রমে নিঃসার হয়ে আসা দেহগহ্বরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলোকে সচল ও সক্রিয় রাখতে বিশেষ ব্যবস্থা না নিয়ে কোন উপায় আছে কি ? তার শ্রেষ্ঠ উপায়ই হচ্ছে ইয়োগা বা যোগ-ব্যায়াম। স্নায়ু গ্রন্থি রক্তনালী শিরা-উপশিরা ও দেহের অভ্যন্তরস্থ প্রতিটা দেহযন্ত্রের যথাযথ ব্যায়ামের মধ্য দিয়ে এগুলোকে পরিপূর্ণ সতেজ ও কার্যকর রাখতে ইয়োগাই অনন্য মাধ্যম। এ ক্ষেত্রে যোগাসনগুলো ছাড়াও বিভিন্ন মুদ্রাগুলোর সমকক্ষ কোন পদ্ধতি একমাত্র ইয়োগা বা যোগ-ব্যায়াম ছাড়া অন্য কোন ব্যায়ামে এখনো আবিষ্কৃত হয় নি। যেভাবে হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুসের সক্রিয় সুস্থতা রক্ষার একমাত্র উপায়ই হচ্ছে ইয়োগার শ্বাস-ব্যায়াম প্রাণায়াম। এমনকি অত্যাবশ্যকীয় ইন্দ্রিয়গুলোর কার্য়কর সুরক্ষার জন্যেও ইয়োগা বা যোগ-ব্যায়াম অপ্রতিদ্বন্দ্বী।

খাবার গ্রহণ করলেই দেহের কাজ শেষ হয়ে যায় না। এই খাদ্য থেকে বিপাক ক্রিয়ার মাধ্যমে প্রয়োজনীয় খাদ্য-উপাদান ও খাদ্যরস সংগ্রহ শেষে পরিত্যক্ত খাদ্যবর্জ্যগুলো মল-মূত্র ঘাম বা কফ হিসেবে শরীর থেকে বের করে দিতে হয়। এই প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ হলেও শরীর অসুস্থ হয়ে পড়তে বাধ্য। এই প্রক্রিয়াটাকে সুস্থ সচল রাখতে অন্য সাধারণ ব্যায়ামে কোন উপায় না থাকলেও ইয়োগা বা যোগ-ব্যায়ামে প্রয়োজনীয় ধৌতিগুলো খুবই কার্যকর উপায়।

জীবন যাপনের চলমান বাস্তবতায় যে সমাজ রাজনীতি অর্থনীতি রাষ্ট্র পরিবেশ ও পরিস্থিতি উদ্ভুত স্ট্রেস বা মনো-দৈহিক চাপের মধ্য দিয়ে প্রতিটা মুহূর্ত পার করতে হয় আমাদের, তা থেকে পরিত্রাণের যে ছটফটানি, এটা আমাদের ব্যক্তি ও সামাজিক জীবনে প্রতিনিয়ত ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলে যাচ্ছে। সেই দুঃসহ চাপের উৎস পরিবর্তনের সুযোগ বা সামর্থ হয়তো আমাদের নেই। কিন্তু সেই অসহনীয় চাপ সফলভাবে মোকাবেলা করতে না পারলে স্নায়ুরোগসহ যে মনো-দৈহিক সমস্যা বা রোগের বিস্তার ঘটে, প্রয়োজনীয় শিথিলায়ন ও প্রয়োজনীয় নিরাময়ের ব্যবস্থা না নিলে আমাদের অস্তিত্বই হুমকির মুখে পড়ে যাবে। এই মনো-দৈহিক সমস্যা উত্তরণে অনন্যোপায় আমাদেরকে এ জন্যেও ইয়োগার আশ্রয়ই নিতে হবে।

প্রিয় পাঠক, চিন্তা বা ধারণা স্বচ্ছ না হলে আয়নায় নিজের অবয়ব দেখেও স্পষ্ট করে বুঝার উপায় নেই যে, বস্তুত যা হওয়ার কথা, নিজের সাথে তার কোথায় কেন কিভাবে কতটুকু তফাৎ বা পার্থক্য পরিদৃষ্ট হচ্ছে এবং কিভাবে তার উত্তরণ ঘটানো সম্ভব। সেজন্যই আমাদের জানার আগ্রহটাকে উন্মুক্ত করে দিতে হবে। দেহ-মনের সার্বিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা করে সুস্থ-সুন্দর জীবন-যাপনের এ যাবৎ শ্রেষ্ঠ উপায় যেহেতু ইয়োগা বা যোগ-ব্যায়াম চর্চা, তাই প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি জানার সাথে সাথে পরিপূর্ণভাবে অভ্যাসের সুবিধার্থে ইয়োগা দর্শনটাকেও জানা আবশ্যক বিবেচনা করি। আমি কেন ইয়োগা চর্চা করবো তা যেমন বুঝতে হবে, তেমনি জানতে হবে ইয়োগা কী বা এর ইতিহাস, আধুনিক ইয়োগার জনক হিসেবে চিহ্ণিত গুরু পতঞ্জলি কেন তাঁর অভ্রান্ত অষ্টাঙ্গযোগ মানব সভ্যতাকে উপহার দিয়েছেন এবং সম্পূর্ণ প্রায়োগিক ও মনো-দৈহিক স্বাস্থ্য দর্শন হওয়া সত্ত্বেও অনেকেই এটাকে ধর্মীয় আধ্যাত্মিক দর্শন ভেবে ভুল করে ফেলেন কেন ? কিসের ভিত্তিতে আমরা ইয়োগা অনুশীলন করবো এবং অন্য ব্যায়ামের সাথে এর মৌলিক ভিন্নতা কোথায় তা যেমন জানতে হবে, তেমনি এর জ্ঞাতব্য বিষয়গুলোও মনোযোগ সহকারে ধারণ করে নিতে হবে। এসব বিষয় আগ্রহে বিশ্বাসে অনুধাবন করে নিজের প্রতি আস্থা ফিরে পেলেই কেবল নিজেকে ইয়োগা চর্চায় প্রস্তুত বলে গণ্য করতে হবে। এবং এ জন্য আপনাকে প্রতিদিন কেবল নিজের জন্য তিরিশটি মিনিট ব্যয় করতে প্রতিজ্ঞ হতে হবে।

ইয়োগা একটি পরিপূর্ণ দর্শন। অমিত ধৈর্য্য, প্রয়োজনীয অনুশীলন ও ধাপে ধাপে উত্তরণের মধ্য দিয়ে মনো-দৈহিক স্বাস্থ্য ও সামর্থ অর্জনের মাধ্যমে পরিপূর্ণ মানবসত্তার চরম উৎকর্ষতা অর্জনের উপায়ই এই দর্শনের অভীষ্টতা। ব্যক্তি তার চেষ্টা ও সামর্থ্য অনুযায়ী ফললাভ করে থাকেন। সাধক যোগী পুরুষ যেমন প্রয়োজনীয় তপস্যার মাধ্যমে নিজেকে আধ্যাত্মিক শিখরে আরোহন করতে পারেন, তেমনি ব্যক্তি-সাধারণের দৈহিক সুস্থতা ও সামর্থ অর্জনের জন্য এখানে উল্লেখ রয়েছে প্রচুর আসন, মুদ্রা, প্রাণায়ামধৌতি অভ্যাসের। যোগশাস্ত্রিরা এগুলোর প্রতিটার কার্য-কারণ, সতর্কতা ও ফললাভের ব্যাখ্যাও দিয়েছেন সুন্দরভাবে। এমনকি প্রচলিত রোগ-বালাই নিরাময় কিংবা তা থেকে মুক্ত থাকার উপায়ও বাৎলে দিয়েছেন। দেহগঠন, বয়স কিংবা রোগ বিবেচনায় নিজ প্রয়োজনে ব্যায়াম ও স্বাস্থ্যচর্চা নির্বাচনের কৌশলও বর্ণিত হয়েছে এতে। একমাত্র ইয়োগা ছাড়া মানবদেহ ও মনের এমন পরিপূর্ণ স্বাস্থ্য দর্শন আদৌ আর আছে কিনা জানা নেই।

যদি আমরা আমাদের অবিকল্প এই দেহটিকে সকল কর্মকাণ্ডের কার্য ও কারণ বলে বিশ্বাস করতে সক্ষম হই, তাকে সুস্থ সবল সক্রিয় ও সুন্দর রাখতে উদ্ভুত প্রশ্নটি ‘আপনি কেন ইয়োগা বা যোগ-ব্যায়াম চর্চা করবেন’ এভাবে না হয়ে হওয়া উচিৎ- আপনি কেন ইয়োগা বা যোগ-ব্যায়াম চর্চা করবেন না !

(C) কপিরাইট:
। ইন্টারনেট থেকে সংগৃহিত ও ব্যবহৃত যাবতীয় ছবির নিজ নিজ উৎসের স্বীকৃত স্বত্ব কৃতজ্ঞতার সাথে বহাল রেখে- এই হাইপার-লিঙ্কড পাণ্ডুলিপির সর্বস্বত্ব লেখক কর্তৃক সংরক্ষিত ।

Friday, September 4, 2009

[Yoga] ইয়োগা: সুদেহী মনের খোঁজে । ১০১। প্রয়োজন মতো ব্যায়াম নির্বাচন।


ইয়োগা: সুদেহী মনের খোঁজে । ১০১। প্রয়োজন মতো ব্যায়াম নির্বাচন।
রণদীপম বসু

# নিজ নিজ প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যায়াম নির্বাচন

কারো জন্যেই সবগুলো ব্যায়াম বা যোগ-ব্যায়াম একসাথে একদিনে করা সম্ভব নয় এবং তা উচিত বা প্রয়োজনও নেই। আবার বৈচিত্র্যহীন একই ব্যায়াম রোজ রোজ করলেও একঘেয়ে লাগার সম্ভাবনাই বেশি। এতে করে ব্যায়ামে মনঃসংযোগ ধরে রাখা কষ্টকর হয়ে পড়ে। আর মনঃসংযোগ না থাকলে ইয়োগা বা যৌগিক ব্যায়ামে তেমন সুফল পাওয়া যায় না। এ ছাড়াও বয়স, সামর্থ্য ও শারীরিক জটিলতাজনিত কারণে প্রয়োজন বিবেচনায় সব আসন বা ব্যায়াম সবার জন্য প্রযোজ্যও হয় না। তাই নিজ নিজ প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যায়াম নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয়। এ জন্যে বয়স অনুযায়ী কোন্ কোন্ ব্যায়াম প্রযোজ্য হবে এই ধারণা যেমন থাকা জরুরি, তেমনি শরীরের কোন অঙ্গ বা গ্রন্থির জন্য কোন ব্যায়াম ফলপ্রসূ তাও জানতে হয়। পাশাপাশি কোন্ রোগে কোন্ ব্যায়াম ফলদায়ক তা জানার পাশাপাশি কোন্ রোগের জন্য কোন্ ব্যায়াম অভ্যাস করা নিষেধ বা অনিষ্টকর তাও জানতে হবে। নইলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনাকে কোনভাবেই উড়িয়ে দেয়া যায় না।

একজন সুস্থ ব্যায়াম অভ্যাসকারীকে রোজ গুটিকয় খালি হাতে ব্যায়াম অভ্যাসের পর ২/৩ মিনিট শবাসনে বিশ্রাম নিয়ে ৬ থেকে ৮টি যৌগিক ব্যায়াম যথানিয়মে অভ্যাস করার পর সবশেষে মিনিট পাঁচেক শবাসন করে দৈনন্দিন ব্যায়াম অভ্যাস শেষ করা উচিত। সর্বাঙ্গাসন, মৎস্যাসনশবাসন ছাড়া কোন আসনই এক-দু’মাসের বেশি একনাগাড়ে অভ্যাস করার প্রয়োজন নেই। প্রতি দু’মাস অন্তর ব্যায়াম তালিকায় পরিবর্তন আনা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে দৈনন্দিন তালিকায় হাতের, বুকের, মেরুদণ্ডের ও পায়ের ব্যায়াম হয় মতো কিছু খালিহাতে ব্যায়াম কিংবা আসন এবং বিভিন্ন গ্রন্থি ও স্নায়ুর মধ্যে যাতে রক্ত চলাচল ভালোভাবে হয় সে জন্যে যৌগিক ব্যায়াম হতে নিজ প্রয়োজন মতো ৭/৮টি আসন ও মুদ্রা নির্বাচন করা যেতে পারে। প্রয়োজন হলে এক-দু’টা সহজ-প্রাণায়ামও দৈনন্দিন তালিকায় থাকতে পারে। এভাবে নির্বাচিত ব্যায়াম, আসন ও মুদ্রাগুলো দু’মাস অভ্যাসের পর একঘেয়েমি দূর করতে তালিকাটির আমূল বা আংশিক পরিবর্তন করে নেয়া উচিত। তবে খেয়াল রাখতে হবে, যেন দেহের সব অংশে প্রচুর রক্ত চলাচল করে এবং সর্বাঙ্গাসন, মৎস্যাসনশবাসন প্রভৃতি অত্যাবশ্যকীয় আসনগুলো কোন তালিকা থেকে বাদ না পড়ে।

অসুস্থ ব্যায়াম অভ্যাসকারীদের বেলায় রোগ নির্ণয়ের পর উপযুক্ত পুষ্টিকর খাদ্য ও প্রয়োজনমতো বিশ্রামের পাশাপাশি রোগ অনুযায়ী ৪/৫টি আসন নির্বাচন করে দিনে দু’বেলা সকাল সন্ধ্যায় চর্চা করার অভ্যাস করা যায়।

প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যায়াম নির্বাচন ও দৈনন্দিন তালিকাভুক্তির সুবিধার্থে বয়স, দেহের বিভিন্ন অংশ ও রোগ-নিরাময় বিবেচনায় প্রয়োজনীয় যৌগিক ব্যায়ামের তালিকা জেনে রাখা সবার জন্যেই সুবিধাজনক।

---------------------------------------------------------
(ক) বয়স ও সামর্থ্য উপযোগী যৌগিক ব্যায়ামের তালিকা:

(০১) ৬ থেকে ১২ বছর উপযোগী (ছেলে ও মেয়ে)-
পদ্মাসন, পদহস্তাসন, অর্ধ-চক্রাসন, অর্ধ-চন্দ্রাসন, চন্দ্রাসন, চক্রাসন, ভুজঙ্গাসন, পূর্ণ-ভুজঙ্গাসন, ধনুরাসন, পূর্ণ-ধনুরাসন, উষ্ট্রাসন, পূর্ণ-উষ্ট্রাসন, মৎস্যাসন, শশঙ্কাসন, অর্ধ-মৎস্যেন্দ্রাসন, অর্ধ-কুর্মাসন, পশ্চিমোত্থানাসন, ভদ্রাসন (বদ্ধ-কোণাসন), ব্যাঘ্রাসন, গড়ুরাসন, বৃক্ষাসন, বকাসন, ত্রিকোণাসনশবাসন। (আসনগুলো এক-দু’বারের বেশি অভ্যাস করা ঠিক হবে না।)

(০২) ১৩ থেকে ১৬ বছর উপযোগী (ছেলে ও মেয়ে)-
০১ নং তালিকায় উল্লিখিত ব্যায়াম ও তার সঙ্গে পবন-মুক্তাসন, উত্থিত-পদাসন, শলভাসন, গোমুখাসন, হলাসন, জানুশিরাসন, বিভক্ত-জানুশিরাসন, বজ্রাসন, সুপ্ত-বজ্রাসন, আকর্ণ-ধনুরাসন, সর্বাঙ্গাসন, বদ্ধ-সর্বাঙ্গাসন, পূর্ণ-বদ্ধসর্বাঙ্গাসন, মকরাসন, পূর্ণ-মকরাসন, দণ্ডায়মান একপদ-শিরাসন, সিদ্ধাসন, কুক্কুটাসন, বিপরীতকরণী মুদ্রা ও যোগমুদ্রা

(০৩) ১৭ থেকে ২০ বছর উপযোগী (ছেলে ও মেয়ে)-
০১ ও ০২ নং তালিকায় উল্লিখিত ব্যায়াম ও মুদ্রা এবং তার সঙ্গে গর্ভাসন, কর্ণ-পিঠাসন, উড্ডীয়াননৌলী মুদ্রা (মেয়েদের ঋতু প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পূর্বে উড্ডীয়াননৌলী মুদ্রা অভ্যাস করা উচিত নয়)।

(০৪) ২১ থেকে ৩০ বছর উপযোগী (নারী ও পুরুষ)-
০১, ০২ ও ০৩ নং তালিকায় উল্লিখিত ব্যায়াম ও মুদ্রা এবং তার সঙ্গে শীর্ষাসন, শক্তিচালনী মুদ্রাসহ কয়েকটি সহজ মুদ্রা, বস্তিক্রিয়াসহজ-প্রাণায়াম

(০৫) ৩১ থেকে ৪০ বছর উপযোগী (নারী ও পুরুষ)-
০১, ০২, ০৩ ও ০৪ নং তালিকায় উল্লিখিত ব্যায়াম, মুদ্রা ও প্রাণায়াম-এর অনুরূপ। তবে এমন কোন আসন অভ্যাস করা উচিত হবে না যাতে মেরুদণ্ডের বা দেহের কোন সংযোগস্থলে প্রচণ্ড চাপ পড়ে। যেমন- চক্রাসন, চন্দ্রাসন, পূর্ণ-উষ্ট্রাসন, পূর্ণ-ধনুরাসন, বিভক্ত-জানুশিরাসন, দণ্ডায়মান একপদ শিরাসন ইত্যাদি অভ্যাস না করাই বাঞ্ছনীয়।

(০৬) ৪১ বছর এবং তদুর্ধ্ব বয়সোপযোগী (নারী ও পুরুষ)
৬ থেকে ৮টি সহজ স্বাস্থ্যাসন যেমন- পবনমুক্তাসন, ভূজঙ্গাসন, মৎস্যাসন, সর্বাঙ্গাসন, ধনুরাসন (সহজে যতটুকু সম্ভব), উষ্ট্রাসন (সহজে যতটুকু সম্ভব), হলাসন, জানুশিরাসন ইত্যাদি এবং প্রয়োজন অনুযায়ী দুয়েকটি মুদ্রা ও প্রাণায়াম
৫০ বছরের পর থেকে ভ্রমণ-প্রাণায়াম বিশেষ উপকারী।

---------------------------------------------------------

(খ) দেহের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, শিরা-উপশিরা, স্নায়ু, গ্রন্থি সুস্থ ও সক্রিয় রাখার উপযোগী য়ৌগিক ব্যায়ামের তালিকা:

(০১) মাথা ও কপাল-

(০২) কণ্ঠ বা গলা-

(০৩) কাঁধ-

(০৪) বুক-

(০৫) উদর বা পেট ও বস্তিপ্রদেশ-

(০৬) মেরুদণ্ড-

(০৭) উরু ও তার সংযোগস্থল-

(০৮) নিতম্ব-

(০৯) কোমর-

(১০) হাত-

(১১) পা-

(১২) হৃৎপিণ্ড ও ফুসফুস-

(১৩) জননেন্দ্রিয়-

(১৪) চোখ-

(১৫) কণ্ঠ-

---------------------------------------------------------

(গ) রোগ নিরাময়ে উপযোগী আসন ও মুদ্রা:

(০১) কোষ্ঠবদ্ধতা-

(০২) অজীর্ণ ও অম্লদোষ-

(০৩) আমাশয়-

(০৪) পেটে বায়ু-

(০৫) উদরাময়-

(০৬) স্থূলতা-
খালিহাতে ব্যায়াম ও সূর্য-নমস্কার, পবনমুক্তাসন, পদহস্তাসন, অর্ধ-চন্দ্রাসন, ত্রিকোণাসন, উত্থিত-পদাসন, মৎস্যাসন, সর্বাঙ্গাসন এবং উষ্ট্রাসন, ধনুরাসনহলাসন। রাতে ঘুমানোর পূর্বে দশ-পনেরো মিনিট বজ্রাসন। দিবানিদ্রা নিষিদ্ধ।

(০৭) কৃশতা-

(০৮) রক্তচাপ (উচ্চ/নিম্ন)-

(০৯) হাঁপানি-

(১০) ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র-

(১১) মুখে ব্রণ বা বয়স ফোঁড়া-

(১২) মাথাধরা-

(১৩) তোতলামী-

(১৪) অর্শ-

(১৫) বাতরোগ-

(১৬) অন্ত্রবৃদ্ধি রোগ-

(১৭) পাকস্থলীর বা অন্ত্রের ক্ষত-

(১৮) পক্ষাঘাত-
সকালে বিকেলে ভ্রমণ-প্রাণায়াম। সামর্থ বৃদ্ধির সাথে সাথে খালিহাতে সহজ ব্যায়াম ও বিভিন্ন যৌগিক ব্যায়াম।

(১৯) স্নায়বিক দুর্বলতা-
রোগের উৎস-কারণ হিসেবে চিহ্ণিত রোগ বা জটিলতা দূরীকরণার্থে প্রয়োজন-সংশ্লিষ্ট আসন ও মুদ্রা অভ্যাস।

(২০) যৌনসমস্যা-
প্রাতে সহজ বস্তিক্রিয়া, ভদ্রাসন (বদ্ধ-কোণাসন), উষ্ট্রাসন, শশঙ্গাসন, বিভক্ত-জানুশিরাসন, উড্ডীয়ান, মূলবন্ধ মুদ্রা, মহামুদ্রা, মহাবন্ধমূদ্রা, অগ্নিসার এবং প্রয়োজনে স্নায়বিক দুর্বলতা নিরসন সংশ্লিষ্ট আসন ও মুদ্রা।

---------------------------------------------------------
[Images: from internet]

(চলবে...)

পর্ব: [১০০][**][১০২]

[Yoga] ইয়োগা: সুদেহী মনের খোঁজে...।রোগ-নিরাময়।



---------------------------------------------------------
# ইয়োগা: সুদেহী মনের খোঁজে...।রোগ-নিরাময়।
--------------------------------


---------------------------------------------------------
---------------------------------------------------------

[Yoga] ইয়োগা: সুদেহী মনের খোঁজে । ১০০। নিরাময়: যৌন-সমস্যা।


ইয়োগা: সুদেহী মনের খোঁজে । ১০০। নিরাময়: যৌন-সমস্যা।
রণদীপম বসু

# (১০) যৌন-সমস্যা (Sexual dificulties)

নারী পুরুষের যৌন জীবন বা যৌন প্রণোদনা সম্পর্কিত উদ্ভুত জটিলতাগুলোকেই যৌন সমস্যা হিসেবে চিহ্ণিত করা যেতে পারে। এটা দু’ভাবে হতে পারে- দৈহিক ও মানসিক। সাধারণত যৌন অঙ্গে বা প্রজননতন্ত্রে সৃষ্ট রোগ বা ত্রুটিগুলোই দৈহিক সমস্যা হিসেবে চিহ্ণিত করা হয়, যাকে চিকিৎসাশাস্ত্রে যৌন রোগ বলে। এই যৌন সমস্যা দেখা দেয়ার অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে প্রধান কারণগুলো হচ্ছে-

(০১) যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে আমাদের অজ্ঞতা বা অসাবধানতা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব ও অনিয়ন্ত্রিত যৌন-জীবনযাত্রার কারণে ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস, ফ্যাঙ্গাস ইত্যাদি জীবাণুর মাধ্যমে যৌন অঙ্গে বা প্রজননতন্ত্রে রোগ সংক্রমন ঘটতে পারে, যেমন সিফিলিস, গনোরিয়া, এইডস ইত্যাদি।
(০২) যৌন অঙ্গ বা প্রজননতন্ত্রে জন্মগত ত্রুটি থাকা।
(০৩) কোন কারণে পিটুইটারী, থাইরয়েড, অগ্ন্যাশয় বা যৌন গ্রন্থির কর্মক্ষমতা হ্রাস পেলে তা থেকে নিঃসৃত বিশেষ বিশেষ হরমোনের আপেক্ষিক ঘাটতি বা প্রাবল্যের কারণে সৃষ্ট হরমোনজনিত রোগ থেকে যৌন দুর্বলতা বা অক্ষমতা দেখা দিতে পারে।
(০৪) কোনভাবে সৃষ্ট স্নায়ুরোগ বা স্নায়বিক দুর্বলতার কারণে যৌন প্রণোদনা হ্রাস পেতে পারে।
(০৫) এ ছাড়া অন্য কোন রোগভোগের কারণে দৈহিক বা মানসিক দৌর্বল্যহেতু সাময়িক বা স্থায়ী যৌন অক্ষমতা দেখা দিতে পারে।

রোগ নিরাময়ের উপায়:
যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সচেতন ও সাবধান হলে এবং নিয়ন্ত্রিত ও পরিচ্ছন্ন জীবন যাপনে অভ্যস্ত হলে জীবাণুঘটিত সংক্রামক যৌনরোগ থেকে দূরে থাকা যায়। একান্তই আক্রান্ত হলে যতদ্রুত সম্ভব অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণের মাধ্যমে এসব রোগ থেকে মুক্ত হওয়া যায়।
জন্মগত ত্রুটির লক্ষণ প্রকাশ হওয়া মাত্র ডাক্তার দেখানো জরুরি। প্রাথমিক অবস্থায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সাধারণ চিকিৎসা বা শৈল্যচিকিৎসার মাধ্যমে এই ত্রুটি সারানোর উপায় আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানে রয়েছে।

একইভাবে বিভিন্ন হরমোন গ্রন্থির ত্রুটি বা রোগ চিহ্ণিত করা গেলে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতিতে প্রয়োজনীয় হরমোন ট্যাবলেট বা ইঞ্জেকশান গ্রহণের মাধ্যমে আজকাল এই হরমোনজনিত সমস্যা পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রেখে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক ও কর্মঠ জীবন যাপন করা সম্ভব। যেমন থাইরয়েড গ্ল্যান্ডের সমস্যায় উদ্ভুত বিভিন্ন শারীরিক ও মানসিক জটিলতার সাথে সৃষ্ট যৌন অক্ষমতা কেটে যায় প্রয়োজনীয় হরমোন চিকিৎসার মাধ্যমে। একইভাবে অগ্ন্যাশয় বা প্যাংক্রীয়াস গ্ল্যান্ডের ত্রুটিপূর্ণতায় সৃষ্ট ডায়াবেটিসের যথাযথ চিকিৎসা ও নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে যৌনজীবনসহ স্বাভাবিক জীবন যাপনে কোন সমস্যা থাকে না।

স্নায়বিক দুর্বলতার কারণে সৃষ্ট যৌন সমস্যার ক্ষেত্রে প্রথমেই স্নায়ুরোগের উৎসটাকে চিহ্ণিত করতে হয়। যে রোগ বা সমস্যার জন্যে সংশ্লিষ্ট স্নায়ুরোগের উৎপত্তি, তা দূর করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলেই স্নায়ুরোগের নিরাময়ের সাথে সাথে এ রোগ থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়। নিয়মিত সুষম খাবার গ্রহণ ও প্রয়োজনীয় ব্যায়াম বা দৈহিক পরিশ্রমের মাধ্যমে শারীরিক দুর্বলতাজনিত যৌন সমস্যা থেকে দূরে থাকা শুধু অভ্যাসের ব্যাপার।

যোগশাস্ত্রে সুস্থ সুন্দর ও আনন্দময় যৌনজীবন পালনের নিমিত্তে কিছু আসন ও মুদ্রার উল্লেখ পাওয়া যায়। প্রভাতে সহজ বস্তিক্রিয়া সেরে কিছুক্ষণ খালি হাতে ব্যায়াম ও সুর্য-নমস্কার ব্যায়াম করতে হবে। এরপর সামর্থ্য অনুযাযী কিছু যৌগিক ব্যায়াম অভ্যাস করতে হবে। যেমন- গোমুখাসন, ভদ্রাসন (বদ্ধ-কোণাসন), মহাবন্ধমুদ্রা, মহামুদ্রা, শক্তিচালনীমুদ্রা, সর্বাঙ্গাসনমৎস্যাসন ইত্যাদি যথানিয়মে নিয়মিত অভ্যাস করলে অচিরেই অস্বাভাবিক বীর্যক্ষয়ের হাত থেকে পরিত্রাণ পেয়ে সুস্থ দেহ ও মনে দুশ্চিন্তাহীন আনন্দময় যৌনজীবন কাটানো যায়।

অবিবাহিত কিশোর ও যুবকদের দেহে-মনে যখন তখন জেগে ওঠা কামভাব নিয়ন্ত্রণের উপায়ও যোগশাস্ত্রে উল্লেখ রয়েছে। যখনই কামভাব জাগবে তখনই তার গোমুখাসনে উপবেশন করলে কামভাব একেবারে দূর হয়ে যাবে। যোগশাস্ত্রানুযায়ী কামোত্তেজনা দমনের সর্বাপেক্ষা সহজ ও শ্রেষ্ঠ উপায় হলো- মহাবন্ধমুদ্রা অভ্যাসের পরই মহামুদ্রা অভ্যাস করা। যখনই মনে কামভাব জাগবে তখনই যদি গুহ্যদ্বার ও তলপেট আকর্ষণ ও বিকর্ষণ করে একবার মহাবন্ধমুদ্রা অভ্যাস করে তার পরই মহামুদ্রা অভ্যাস করা যায়, তাহলে কামরিপু সহজেই দমিত হয়।
[Images: from internet]

(চলবে...)

পর্ব: [৯৯][**][১০১]

Thursday, September 3, 2009

[Yoga] ইয়োগা: সুদেহী মনের খোঁজে । ৯৯। নিরাময়: ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র।


ইয়োগা: সুদেহী মনের খোঁজে । ৯৯। নিরাময়: ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র।
রণদীপম বসু

# (০৯) ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র (Diabetes)

ডায়াবেটিস কোন ছোঁয়াচে বা সংক্রামক রোগ নয়। এটি একটি বিপাকজনিত রোগ। আমাদের পাকস্থলী সংলগ্ন ঠিক যেখান থেকে ুদ্রান্ত্রের শুরু সেখানে অগ্ন্যাশয় বা প্যাংক্রীয়াস (Pancreas) নামক একটি গ্রন্থি রয়েছে, যা থেকে ইনসুলিন নামে এক ধরনের হরমোন নিঃসৃত হয়। এই ইনসুলিন আমাদের গৃহিত খাবার থেকে সৃষ্ট গ্লুকোজকে ভেঙে শরীরের শক্তি উৎপাদনসহ বিভিন্ন কাজে লাগাতে সাহায্য করে। কোন কারণে এই ইনসুলিনের অভাব হলে এর সম্পূর্ণ বা আপেক্ষিক ঘাটতির কারণে শরীরে বিপাকজনিত গোলযোগ সৃষ্টি হয়ে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বেড়ে যায়। অর্থাৎ শরীর আর গ্লুকোজকে কাজে লাগাতে পারে না। ফলে অতিরিক্ত গ্লুকোজ একসময় প্রস্রাবের সাথে বেরিয়ে আসে। এই সামগ্রিক অবস্থাকে ডায়াবেটিস বলা হয়। এই রোগে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ দীর্ঘস্থায়ীভাবে বেড়ে যায়।

সুস্থ লোকের রক্তরস বা রক্তের প্লাজমায় গ্লুকোজের পরিমাণ থাকে অভুক্ত অবস্থায় ৬.৪ মিলি মোল-এর কম এবং খাওয়ার দু’ঘণ্টা পর ৭.৮ মিলি মোল-এর কম। কিন্তু অভুক্ত অবস্থায় রক্তের প্লাজমায় গ্লুজোজের পরিমাণ ৭.৮ মিলি মোল বা তার বেশি হলে অথবা ৭৫ গ্রাম গ্লুকোজ খাওয়ার দু’ঘণ্টা পরে রক্তের প্লাজমা বা রক্তরসে গ্লুকোজের পরিমাণ ১১.১ মিলি মোল বা তার বেশি হলে তাকে ডায়াবেটিস রোগ হিসেবে সনাক্ত করা হয়। এই ডায়াবেটিস হলে অগ্ন্যাশয় থেকে প্রয়োজনমতো কার্যকরী ইনসুলিন নিঃসরণ হয় না বা এর কার্যকারিতা হ্রাস পায় বলে দেহে শর্করা, আমিষ ও চর্বি জাতীয় খাদ্যের বিপাকও সঠিক হয় না। ফলে শরীরে বিভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা দেয়।

রোগের লক্ষণ:
প্রথম অবস্থায় (১) ঘন ঘন প্রস্রাব পাওয়া, (২) বার বার পিপাসা লাগা, (৩) ঘামের পরিমাণ কমে যাওয়া, (৪) মুখে প্রায় সবসময় মিষ্টি স্বাদ অনুভব করা।
রোগ পুরাতন হলে (১) বেশি বেশি ক্ষুধা পাওয়া, (২) যথেষ্ট খাওয়া সত্ত্বেও ওজন কমে যাওয়া, (৩) ক্লান্তি ও দুর্বলতা বোধ করা, (৪) মাথা ধরা, (৫) মাথা ঘোরা, (৬) কোষ্ঠকাঠিন্য, (৭) মূত্রাশয়ে জ্বালা করা, (৮) ক্ষত শুকাতে বিলম্ব হওয়া, (৯) খোশ-পাঁচড়া, ফোঁড়া প্রভৃতি চর্মরোগ দেখা দেওয়া, (১০) চোখে কম দেখা ইত্যাদি।
কোন ব্যক্তি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হয়েছেন কি না, ঐ ব্যক্তির মূত্র ও রক্ত পরীক্ষা করে তা নিশ্চিতভাবে জানা যায়।

রোগের কারণ:
যে কেউ যে কোন বয়সে যে কোন সময় ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হতে পারেন। এর পেছনে প্রধান কারণই হচ্ছে অগ্ন্যাশয়ের কার্যকারিতা হ্রাস। অগ্ন্যাশয়ের বিভিন্ন রোগ বা অন্যান্য হরমোনের আধিক্য হলে, কিংবা কোন ঔষধ বা রাসায়নিক দ্রব্যের সংস্পর্শে বা শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতার জটিলতার কারণে অগ্ন্যাশয় আক্রান্ত হয়ে এর কর্মক্ষমতা হ্রাস পেতে পারে।
স্বাভাবিকভাবে তিন শ্রেণীর লোকের ডায়াবেটিস হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে-
(ক) বংশে যেমন বাবা-মা বা রক্ত সম্পর্কীয় নিকট আত্মীয়ের ডায়াবেটিস থাকলে, (খ) যাদের নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে ওজন বেশি এবং (গ) যারা ব্যায়াম বা শারীরিক পরিশ্রমের কোন কাজ করেন না। এছাড়া যারা সবসময় মানসিক দুঃশ্চিন্তাগ্রস্ত থাকেন তাদেরও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশিমাত্রায় থাকে।

রোগ নিরাময়ের উপায়:
সাধারণত ডায়াবেটিস রোগ সহজে সারে না। তবে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ করে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে এ রোগ খুব ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। এবং তা নিয়ন্ত্রণে রেখে প্রায় স্বাভাবিক কর্মঠ জীবন যাপন করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে নিজের অবস্থা ও রোগ সম্পর্কে বিস্তারিত জানা ও নিয়ম-নীতি মেনে চলতে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের প্রয়োজনীয় পরামর্শ ও নির্দেশনা বাঞ্ছনীয়। এটা সম্পূর্ণ বিপাকজনিত রোগ বলে খাদ্যগ্রহণের ক্ষেত্রে অতি সতর্ক থাকার বিকল্প নেই। সাথে সাথে জীবনধারায় শৃঙ্খলাও অতি আবশ্যক।

ডায়াবেটিস রোগীর শরীরের ওজন বেশি থাকলে তা কমিয়ে এবং ওজন কম থাকলে বাড়িয়ে স্বাভাবিক মাত্রায় নিয়ে এসে এই স্বাভাবিক মাত্রা বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে। চিনিজাত বা মিষ্টি জাতীয় খাবার বাদ দিতে হবে। শর্করা জাতীয় খাবার যেমন চাল আটা দিয়ে তৈরি খাবার, মিষ্টি ফল ইত্যাদি কিছুটা হিসাব করে খেতে হবে। আঁশ জাতীয় খাবার যেমন ডাল, শাক-সবজী, টক ফল ইত্যাদি বেশি বেশি খেতে হবে। সম্পৃক্ত বা স্যাচুরেটেড ফ্যাট জাতীয় খাবার যেমন ঘি, মাখন, চর্বি, ডালডা, মাংস ইত্যাদি খাবারের বদলে অসম্পৃক্ত বা আনস্যাচুরেটেড ফ্যাট জাতীয় খাবার যেমন সয়াবিন তেল, সরিষার তেল ইত্যাদি উদ্ভিজ্জ তেল এবং সব ধরনের মাছ খাওয়া অভ্যাস করতে হবে। চিকিৎসকের নির্দেশিত পরিমাণের বাইরে ক্যালরীবহুল খাবার খাওয়া যাবে না। খাবার নির্দিষ্ট সময়ে খেতে হবে এবং কোন বেলায় খাবার বাদ দেয়া বা আজ কম কাল বেশি এভাবে খাবার খাওয়া উচিত হবে না। তিতা জাতীয় খাবার যেমন নিয়মিত করলার রস খেলে ডায়াবেটিস রোগের প্রকোপ কম হতে পারে।

জীবনধারায় শৃঙ্খলা না মানলে ডায়াবেটিস অনিয়ন্ত্রিত হয়ে পড়ে। তখন রক্তের প্রয়োজনীয় ইনসুলিন-সাম্যতা ফিরিয়ে আনতে চিকিৎসক নির্দেশিত পরিমাণে ইনসুলিন ইঞ্জেকশান গ্রহণের মাধ্যমে তা নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তবে এ-সবই সাময়িক ব্যবস্থা। সর্বক্ষেত্রে নিয়মিত ও পরিমাণমতো সুষম খাবার ও প্রয়োজনীয় ব্যায়াম বা দৈহিক পরিশ্রম এই রোগ নিয়ন্ত্রণ ও নিরাময়ে অত্যাবশ্যক বিবেচনা করা হয়। ডায়াবেটিস রোগীদের এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের মধ্যে না রাখলে এর উপজাত হিসেবে হৃদরোগসহ শরীরে বহু রোগের সৃষ্টি হতে পারে যা রোগীর জন্য অত্যন্ত জটিল পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। তাই সর্বাবস্থায় ডাক্তারের পরামর্শ একান্ত বাঞ্ছনীয়।

যোগশাস্ত্রে এই রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় করতে প্রাচীন মুনিঋষিদের প্রবর্তিত কিছু নিয়ম ও যোগব্যায়াম অভ্যাসের উল্লেখ রয়েছে। যেমন-
ভাত বা রুটির বদলে কাঁচকলা সিদ্ধ, মানকচু বা ওল সিদ্ধ খাওয়া। অম্লধর্মী আমিষ জাতীয় খাদ্য, যথা- মাছ, মাংস, ডিম ইত্যাদি গ্রহণ না করে ক্ষারধর্মী আমিষ জাতীয় খাদ্য, যথা- দই, ছানা, নারিকেল ইত্যাদি গ্রহণ করা। নিম গাছের বাকল অথবা তেজপাতা ভেজানো জল খালিপেটে পান করলে বহুমূত্র রোগীরা দ্রুত ফল লাভ করে। প্রথম দিন এক গ্লাস জলে ১টি তেজপাতা, পরের দিন ২টি, এভাবে ২১ দিনের দিন ২১টি তেজপাতাসহ জল পান করতে হবে। পুনরায় ১টি করে কমিয়ে ২১ দিনের দিন ১টি তেজপাতা ভেজানো জল পান করতে হয়। অর্থাৎ মোট ৪২ দিন পান করতে হয়। পাশাপাশি কিছু যোগব্যায়াম অভ্যাস করা প্রয়োজন-

এই যোগ ব্যায়ামগুলো অভ্যাসের পূর্বে কিছু খালি হাতে ব্যায়াম বা সূর্য-নমস্কার ব্যায়াম অভ্যাস করে নিলে আরেকটু দ্রুত ফললাভ হয়।

উপরোক্ত খাদ্যতালিকা থেকে নিজ অভিরুচিমতে প্রস্তুত একটা নিয়ন্ত্রিত ও সুষম খাদ্যতালিকা অনুযায়ী খাদ্যগ্রহণের সাথে সাথে নিয়মিত ২/৩ মাস উল্লেখিত যৌগিক ব্যায়ামগুলো অভ্যাস করলে প্লীহা, যকৃত ও অগ্ন্যাশয় সুস্থ ও সক্রিয় হয়ে ওঠলে আমিষ ও শ্বেতসাত জাতীয় খাদ্য থেকে গ্লুকোজ তৈরি করে যকৃতে গ্লাইকোজেন রূপে সঞ্চিত করে রাখে এবং এই গ্লাইকোজেন দৈহিক নানা প্রয়োজনে যথাসময়ে ব্যয়িত হয়ে রোগীকে রোগমুক্ত করতে সহায়তা করে।
এক্ষেত্রেও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের সাথে অবশ্যই পরামর্শ করে নেয়া উচিত। তাতে রোগমুক্তির জন্য তা আরো সহায়ক হবে।
[Images: from internet]

(চলবে...)

পর্ব: [৯৮][**][১০০]