| ইয়োগা: সুদেহী মনের খোঁজে । ৯৮। নিরাময়: হাঁপানি বা অ্যাজমা ।
রণদীপম বসু
# (০৮) হাঁপানি বা অ্যাজমা (Asthma)
স্বাভাবিকভাবে আমরা যে শ্বাস গ্রহণ করি তা শ্বাসনালীর মধ্য দিয়ে ফুসফুসে যায়। কিন্তু কোন কারণে শ্বাসনালী সঙ্কুচিত হয়ে এলে বা যথানিয়মে প্রসারিত হতে না পারলে স্বাভাবিক নিয়মে শ্বাস নেয়া বা ছাড়া সম্ভব হয় না, ফলে শ্বাস নিতে ও ছাড়তে কষ্ট হয় এবং বুকে হাঁপ ধরে যায়। এই অবস্থাকেই হাঁপানি বা শ্বাস-রোগ বলে। সাধারণ দৃষ্টিতে এ রোগ জীবনসংশয়কারী না হলেও তা মানুষের জীবনীশক্তিকে তিলে তিলে নষ্ট করে দেয এবং জীবন দুর্বিষহ করে তোলে।
সাধারণত শৈশবে ৪/৫ বছর বয়সে এ রোগ হলে বয়স বাড়ার সাথে সাথে ১৩/১৪ বছর বয়সের দিকে তা সেরে যায় এবং প্রৌঢ়ত্বের শেষে অনেক সময় তা আবার ফিরে আসতেও দেখা যায়। তবে বয়সকালে যাদের হাঁপানি দেখা দেয়, সহজে ছাড়তে চায় না, তা নিয়ন্ত্রণ করেই চলতে হয়।
রোগের লক্ষণ:
হাঁপানিতে আক্রান্ত হলে রোগীর শ্বাস নিতে ও ছাড়তে কষ্ট হয় এবং বুকে হাঁপ ধরে গলা দিয়ে একটা সাঁ সাঁ শব্দ হতে থাকে। বুকে কান পাতলে ভেতরে চিঁ চিঁ শব্দ শোনা যায়। বায়ুর সমুদ্রে ডুবে বাস করেও নিশ্বাসের মধ্য দিয়ে এক মুঠ বাতাস নেয়ার তাগিদে রোগীর চোখে মুখে যে অসহায় আর্তি বা আকুতি ফুটে ওঠে, সে দৃশ্য সত্যিই ভয়ঙ্কর। যেকোন সময় রোগীকে এ রোগ আক্রমণ করতে পারে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শেষরাতে এ রোগের আক্রমণ ঘটে থাকে এবং ঘুম ভাঙার সাথে প্রবল হয়ে ওঠে। ঠাণ্ডা ঋতু বা আবহাওয়ায় এ রোগ বৃদ্ধি পায়। ক্ষুধামন্দা, অজীর্ণ ও অবসাদ হাঁপানির পূর্ব লক্ষণ।
রোগের কারণ:
কোন কারণে শ্বাসনালীতে শ্লেষ্মা জমলে বা স্নায়ুর দুর্বলতার জন্য শ্বাসনালী ঠিকমতো সঙ্কুচিত ও প্রসারিত হতে না পারলে হাঁপানি রোগ দেখা দেয়। দীর্ঘদিন দেহে বিশুদ্ধ রক্তের অভাবে ফুসফুস ও স্নায়ুগ্রন্থি স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে না পারলে প্রয়োজনমতো শ্বাসনালী প্রসারিত হতে পারে না। বংশানুক্রমেও জেনেটিক ফ্যাক্টর হিসেবে এ রোগ হতে দেখা যায়। আবার জন্ম থেকে বা আঘাতজনিত কারণে শ্বাসনালী ক্ষতিগ্রস্ত বা নাসারন্ধ্রের দেয়াল বিকৃত হলে কিংবা নাকের দু’পাশের সাইনাসে দীর্ঘদিন সর্দি জমে থাকলেও হাঁপানি হয়ে থাকে। এছাড়া কোন কারণে শ্বাসনালী হঠাৎ সংবেদনশীল হয়ে অ্যাকিউট বা হঠাৎ হাঁপানি হতে পারে। হাঁপানি কেন হয় তার সঠিক কারণ আজও নিশ্চিত হতে না পারলেও ডাক্তারদের মতে এলার্জিই এই রোগের প্রধান কারণ। এই এলার্জি বিভিন্ন ধরনের পদার্থ থেকে হতে পারে, যেমন ফুলের পরাগ বা রেণু, পতঙ্গ, ছত্রাক, ওষুধের প্রতিক্রিয়া, রাসায়নিক পদার্থ, ধোঁয়া বা উত্তেজনা সৃষ্টিকারী গ্যাস, খাদ্য হিসেবে ডিম, চিংড়ি মাছ, কাঁকড়া, বেগুন ইত্যাদি। অতিরিক্ত পরিশ্রমে কারো কারো হাঁপানি আসতে দেখা যায়। শ্বাসনালীতে জীবাণুর আক্রমণ থেকে ব্রঙ্কিয়াল অ্যাজমা বা ফুসফুসে জীবাণুর আক্রমণে কার্ডিয়াক অ্যাজমা ইত্যাদি হয়ে থাকে। হৃদরোগও অ্যাজমার অন্যতম কারণ।
রোগ নিরাময়ের উপায়:
জন্মসূত্রে না হয়ে থাকলে হাঁপানির লক্ষণ প্রকাশ পেলেই প্রথমে রোগের উৎস বা কারণ জেনে নিতে হবে- তা কি শ্লেষ্মা, না ফুসফুস, না কি স্নায়ুর দুর্বলতা কিংবা এলার্জি ?
পুরনো শ্লেষ্মা এ রোগের কারণ হলে রোজ সকালে ও সন্ধ্যায় খালিপেটে এক চামচ মধু ও চ্যবনপ্রাশ একসাথে মিশিয়ে এক গ্লাস পাতলা গরম দুধসহ খেতে হবে। ১ তোলা তালমিছরি, একটি তেজপাতা ও একটি লবঙ্গ দু’কাপ পরিমাণ জলে গরম করে দু’বেলা খেলে সমস্ত পুরনো সর্দি উঠে আসবে। হাঁপানির টান বেশি থাকলে একদিন উপবাস করলে টান প্রশমিত হয়। উপবাসের সময় ঠাণ্ডা পানির পরিবর্তে ঈষদোষ্ণ গরম জলে লেবুর রস মিশিয়ে অল্প অল্প করে পান করতে হবে। এ সময় রোগীর বিশ্রাম নেয়া উচিত। উপবাসের পর সতর্কতার সাথে আহার করতে হয়। প্রয়োজনমতো দিনে ৩/৪ বার অল্প অল্প আহার করা উচিত।
যদি ফুসফুস ও সংলগ্ন স্নায়ুজালের দুর্বলতার জন্য হাঁপানি রোগ হয় তবে এই দুর্বলতার কারণগুলো দূর করতে হবে। অনেক কারণে এগুলো দুর্বল হতে পারে। যোগশাস্ত্রকারদের মতে খাবার ঠিকমতো হজম না হলে কোষ্ঠবদ্ধতা ও অজীর্ণ ইত্যাদি রোগের মাধ্যমে বিষাক্ত গ্যাস ও এ্যাসিড প্রভৃতি জমে রক্তের সাথে মিশে দেহের অভ্যন্তরস্থ দেহযন্ত্রকে অকেজো করতে শুরু করে। ফলে ফুসফুস ও স্নায়ুজাল ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। এতে শরীরের কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্যাস শরীর থেকে প্রয়োজনমতো বের হয়ে যেতে না পেরে দেহযন্ত্রকে আরো দুর্বল ও আংশিক অক্ষম করে দেয়। তার ফলে দেহে কেবল হাঁপানি নয়, আরও অনেক মারাত্মক রোগও আক্রমণ করতে পারে।
তাই হাঁপানি রোগীদের আহার ও পথ্য বিষয়ে বিশেষ সতর্কতার প্রয়োজন হয়। এমন কোন খাবার খাওয়া উচিত নয় যাতে হজমের ব্যাঘাত ঘটতে পারে। রোগ নিরাময় না হওয়া পর্যন্ত আমিষ, শর্করা ও চর্বিজাতীয় খাবার পরিহার করা উচিত। হাঁপানি রোগীর খাদ্যে প্রচুর শাকসবজি, ফল, মধু ও দুধ থাকা প্রয়োজন। তেল, ঘি, মাখন, ডিম, মাংস, তৈলযুক্ত মাছ, মশলা ইত্যাদি এই রোগে ক্ষতিকর। ক্ষারধর্মী খাবার বেশি খাওয়া উচিত। কখনো ভরপেট খাওয়া উচিত নয় এবং কোষ্ঠবদ্ধতা যাতে না আসে সেদিকে বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে। কোষ্ঠবদ্ধতা থাকলে রাতে খাবার পর শোবার আগে ৩/৪ চামচ ইসবগুলের ভূষি পানিতে বা দুধে গুলে খেয়ে শুতে হবে। পরদিন প্রাতে ঘুম থেকে উঠে লেবু মিশ্রিত এক গ্লাস গরম জল পান করে শারীরিক অবস্থা অনুযায়ী ভ্রমণ-প্রাণায়াম, উড্ডীয়ান বা অগ্নিসার অভ্যাস করলে কোষ্ঠ পরিষ্কার হয়ে যাবে।
আক্রান্ত অবস্থায় হাঁপানি রোগীর দৌড়াদৌড়ি লাফালাফি ও খেলাধূলা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। প্রথম প্রথম হাঁপানি রোগী প্রথম দুই সপ্তাহ প্রাতঃকৃত সেরে মুক্তস্থানে স্বাভাবিক দম নিতে নিতে ও ছাড়তে ছাড়তে বেড়াবেন। বিকেলেও একইভাবে তা-ই করবেন।
তৃতীয় সপ্তাহ থেকে ভোরে ঘুম থেকে উঠে প্রাতঃক্রিয়া সেরে মুক্তস্থানে পবনমুক্তাসন, অর্ধশলভাসন, ভুজঙ্গাসন, বিপরীতকরণী বা সর্বাঙ্গাসন ও উড্ডীয়ান অভ্যাস করবেন। একমাস পর থেকে এ আসন ও মুদ্রাগুলোর সাথে যোগমুদ্রা, অর্ধকূর্মাসন, মৎস্যাসন ও ধনুরাসন অভ্যাস করবেন। তবে আসন ও মুদ্রাগুলো প্রথম প্রথম ১৫ সেকেন্ড অভ্যাসের পর ১৫ সেকেন্ড শবাসন এভাবে অভ্যাস করে করে অভ্যস্ত হয়ে পরবর্তীতে প্রয়োজনানুযায়ী সময় বাড়াতে পারেন।
এসব যৌগিক আসন ও মুদ্রার সাথে হাঁপানি রোগীরা একটি শ্বাস-ব্যায়াম করবেন। রোদ বাড়লে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে কিংবা পদ্মাসনে বসে বা শিরদাঁড়া সোজা করে স্বাচ্ছন্দ্য অনুযাযী বসে হাঁ করে যতোটা সম্ভব দম টেনে আস্তে আস্তে ফুসফুসে নিয়ে ২সেঃ থেকে ৫সেঃ দম বন্ধ করে থাকতে হবে। এরপর ধীরে ধীরে নাক দিয়ে দম ছাড়তে হবে। এভাবে দশ থেকে পনের মিনিট শ্বাস-ব্যায়ামটি করতে হবে। বিকেলে রোদের তেজ থাকতে থাকতে একইভাবে শ্বাস-ব্যায়ামটি দশ-পনের মিনিট অভ্যাস করতে হবে। তবে হাঁপানি রোগীদের এই শ্বাস-ব্যায়াম কখনোই ঠাণ্ডা বাতাসে করা উচিত নয়। এবং হাঁপানি রোগীদের কখনো বেশি ঠাণ্ডা পানিতে স্নান করা ঠিক নয়। রোদে জল রেখে বা উনুনে গরম করে সেই উষ্ণ জলে স্নান করলে উপকার পাওয়া যায়।
এভাবে বিভিন্ন আসন অভ্যাস এবং পথ্য ও নিয়মগুলো পালন করলে এ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া সম্ভব। যদি এ রোগ জীবাণুঘটিত হয় তাহলে ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী ঔষধ সেবন করে জীবাণুমুক্ত হতে হবে। আর যদি এলার্জিঘটিত হয় তবে এলার্জির উৎসটাকে পরিহার করে চলতে হবে। না হলে কোন ব্যায়াম বা অনুষঙ্গেও কোন কাজ হবে না। তবে সর্বাবস্থায় ডাক্তারের পরামর্শ একান্ত বাঞ্ছনীয়।
[Images: from internet](চলবে...)
পর্ব: [৯৭][**][৯৯]