Saturday, August 29, 2009

[Yoga] ইয়োগা: সুদেহী মনের খোঁজে । ৯৬। নিরাময়: উচ্চ ও নিম্ন রক্তচাপ ।


| ইয়োগা: সুদেহী মনের খোঁজে । ৯৬। নিরাময়: উচ্চ ও নিম্ন রক্তচাপ ।
রণদীপম বসু

# (০৬) রক্তচাপ (Blood-pressure):

চিকিৎসা শাস্ত্র অনুযায়ী রক্তচাপ দু-ধরনের, উচ্চ-রক্তচাপ (High blood-pressure বা Highper-tension)ও স্বল্প বা নিম্ন-রক্তচাপ (Low blood-pressure বা Highpo-tension)।
আমাদের দেহের রক্ত সংবহন বা সঞ্চালনে হৃদপিণ্ডের ভূমিকা প্রধান। হৃদপিণ্ডের কাজই হচ্ছে নিরবচ্ছিন্ন পাম্পের সাহায্যে সঙ্কুচিত-প্রসারিত হয়ে চাপ প্রয়োগ করে রক্তকে সারাদেহে ধমনী ও শিরা-উপশিরা তথা রক্তনালীর মাধ্যমে দেহের সর্বত্র ছড়িয়ে দিয়ে রক্তের আদান-প্রদান নিয়ন্ত্রণ করা। হৃদপিণ্ড সঙ্কুচিত হয়ে তার ভেতরের রক্তকে চাপ দিয়ে রক্তবাহী নালীর মধ্যে দিয়ে বের করে দেহে পাঠিয়ে দেয়ার প্রক্রিয়াকে বলে সঙ্কোচন বা সিস্টল (Systol) এবং প্রসারিত হয়ে রক্ত টেনে ভেতরে নেয়াকে বলে প্রসারণ বা ডায়াস্টল (Diastol)। হৃদপিণ্ড যখন পাম্প করে রক্ত সমস্ত দেহে ছড়িয়ে দেয় তখন তার পর্যায়ক্রমিক সিস্টল-ডায়াস্টল প্রক্রিয়া চলতে থাকে এবং হৃদপিণ্ডের এই পর্যাক্রমিক চাপকে বলে সিস্টলিক প্রেসার ও ডায়াস্টলিক প্রেসার। সিস্টলিক থেকে ডায়াস্টলিক প্রেসার সাধারণত ৪০-এর মত কম হয়। সুস্থ মানব-দেহে সাধারণত সিস্টলিক প্রেসার থাকে ১২০ মিলিমিটার এবং ডায়াস্টলিক প্রেসার ৮০ মিলিমিটার। ক্ষেত্র বিশেষে এই মান ১০ কম-বেশি হতে পারে। এটাকেই স্বাভাবিক রক্তচাপ বলা হয়। এর ব্যত্যয় ঘটলে তাকে রোগ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। উভয় ক্ষেত্রে এই চাপ বেড়ে গেলে তাকে উচ্চ-রক্তচাপ এবং কমে গেলে নিম্ন-রক্তচাপ হিসেবে চিহ্ণিত করা হয়। তবে উচ্চ-রক্তচাপকেই বেশি বিপজ্জনক মনে করা হয়।
রক্তচাপ রোগে আক্রান্ত ব্যক্তি প্রথম অবস্থায় শারীরিক দুর্বলতা, মাথায় ভারবোধ, মাথাধরা, মাঝে মাঝে বুক ধড়ফড় করা, কখনো কখনো দম নিতে ও ছাড়তে কষ্টবোধ হওয়া, কানে সোঁ সোঁ আওয়াজ শোনা, চোখে টান টান ভাব, দন্তপাটির আলগা আলগাভাব, রাতে ঘুমের ব্যাঘাত ও ঘন ঘন প্রস্রারের বেগ হওয়া ইত্যাদি সবক'টি অথবা যেকোন দু’তিনটি লক্ষণ অনুভব করে থাকেন।

(৬.১) উচ্চ-রক্তচাপ
রক্তের স্বাভাবিক চাপ (সিস্টল ১২০ ও ডায়াস্টল ৮০) থেকে মাত্রা বেড়ে গেলে তাকে বলে উচ্চ-রক্তচাপ।

রক্তচাপবৃদ্ধি রোগের লক্ষণ:
রক্তচাপ বৃদ্ধি পেলে মাথায় যন্ত্রণা, কখনো ঘাড়ে ব্যথা এবং শরীর অস্থির হয়ে কাঁপতে থাকে। কখনোবা কানের মধ্যে সোঁ সোঁ আওয়াজ হয়। চিৎকার বা গণ্ডগোল একেবারে সহ্য হয় না এবং অল্পতে অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলেন। রাতে ভালো ঘুম হয় না, বাঁদিকে কাৎ হয়ে শুতে কষ্ট হয়। কখনো কখনো রোগী জ্ঞান পর্যন্ত হারাতে পারেন। চিকিৎসাশাস্ত্রে রক্তচাপ ১৫৫ মিলিমিটারের বেশি হলে এই রোগে আক্রান্ত রোগীকেই হৃদরোগী বলা হয়।


রক্তচাপ বৃদ্ধির কারণ:
শরীর সুরক্ষা ও পুষ্টি বৃদ্ধির জন্য যতোটা প্রোটিন জাতীয় খাদ্য দরকার এবং শরীরের তাপ ও কর্মশক্তি ঠিক রাখার জন্য যতোটা চর্বি ও শর্করা জাতীয় খাদ্যগ্রহণ দরকার, দীর্ঘকাল ধরে তার চেয়ে অতিরিক্ত মাত্রায় গ্রহণ করা এ রোগের অন্যতম প্রধান কারণ। আমাদের দেহে প্রোটিন সংরক্ষণের কোন ব্যবস্থা না থাকায় এসব অতিরিক্ত মাত্রায় গৃহিত খাদ্যের প্রয়োজনাতিরিক্ত প্রোটিনকে দেহ থেকে বের করে দিতে দেহযন্ত্রগুলোর যে অতিরিক্ত পরিশ্রম করতে হয়, তাতে একটা সময়ে এসে দেহযন্ত্রগুলো ধীরে ধীরে দুর্বল ও অকেজো হয়ে পড়তে থাকে। ফলে পরে আর ঠিকভাবে তা করতে পারে না বলে দেহে থেকে যাওয়া অতিরিক্ত প্রোটিন অ্যামোনিয়াজাত উপাদানে পরিবর্তিত হয়ে রক্তে মিশে গিয়ে ধমনী ও শিরা-উপশিরার নমনীয়তা নষ্ট করে দেয়। ফলে হৃৎপিণ্ড সহজে দেহে রক্ত আদান-প্রদান করতে পারে না। আবার আবার অতিরিক্ত গৃহিত চর্বি জাতীয় উপাদান রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়ায় রক্তের চর্বি-ঘনত্ব যেমন বেড়ে যায়, এইভাবে এই কোলেস্টেরল ধমনী ও শিরা-উপশিরার দেয়ালে জমে রক্ত চলাচলের পথ সরু করে দেয়। এ অবস্থায় হৃদপিণ্ডকে অতিরিক্ত চাপ প্রয়োগ করে দেহে রক্ত আদান-প্রদান করতে হয়। এই অতিরিক্ত চাপকেই রক্তচাপ বৃদ্ধি বলা হয়। এই অতিরিক্ত চাপ বেশি বৃদ্ধি পেলেই রক্তবাহী নালী যেকোন সময় যেকোন জায়গায় ফেটে বা ছিঁড়ে যেকোন দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে।
এই দুর্ঘটনা বুকে হলে রোগী বুকে প্রচণ্ড ব্যথা অনুভব করেন, গা দিয়ে ঘাম ঝরতে থাকে। এই অবস্থাকে বলে হার্ট অ্যাটাক (Heart Attack)। আর তা যদি মস্তিষ্কে ঘটে তবে তাকে বলা হয় করোনারী বা সেরিব্রাল থ্রম্বোসিস। মস্তিষ্ক দেহের স্নায়ুজাল নিয়ন্ত্রণ করে বলে এরকম দুর্ঘটনায় দেহের আংশিক বা সম্পূর্ণ পক্ষাঘাত (Paralysis) কিংবা মৃত্যুও ঘটতে পারে।

রক্তচাপবৃদ্ধি রোগ নিরাময়ের উপায়:
উচ্চ-রক্তচাপে আক্রান্ত ব্যক্তিকে খাদ্যগ্রহণে খুবই সচেতন ও সতর্কতার পরিচয় দিতে হবে। চর্বিসমৃদ্ধ আমিষ জাতীয় খাদ্যগ্রহণ একেবারে বন্ধ রাখাই উত্তম। ভাত বা রুটি অল্প পরিমাণে খাবেন, কিন্তু মাখন, ঘি বা যে কোন চর্বিজাতীয় উপাদান পুরোপুরি বর্জন করতে হবে। টাটকা শাকসবজি, মাখন-তোলা দুধ, ঘোল বা মাঠা, পাকা বা শুকনো ফল এই রোগের উৎকৃষ্ট খাবার। রোগী অতিরিক্ত মোটা হলে দুধ খাওয়া যাবে না। চিনির বদলে গুড় বা মধু খাওয়া যেতে পারে। এ রোগে যতটা সম্ভব লবণ কম খেতে হবে এবং কাঁচা-লবণ খাওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ। ক্ষারজাতীয় সহজপাচ্য খাদ্যগ্রহণ করতে হবে, বেশি তেল-মশলাযুক্ত খাবার ও ডিমের কুসুম খাওয়া যাবে না। সরিষার তেল বা অপরিশোধিত রেপসিড তেল খাওয়া এই রোগীর জন্য ক্ষতিকারক। হৃদরোগীদের জন্য অল্প পরিমাণে সূর্যমুখী, বাদাম বা নারকেল তেল দিয়ে রান্না করা খাবার খাওয়াই উত্তম। মাঝে মাঝে বা সপ্তাহে একদিন পূর্ণ উপবাস থাকা এ রোগীদের জন্য অত্যন্ত ফলদায়ক। উপবাসের সময়টাতে লেবুর রস মিশ্রিত পানি ও ঘোল বা মাঠা পান করা যেতে পারে।

হৃদরোগীদের জন্য ক্রোধ সংবরণ করা একান্তই প্রয়োজন। জোরে কথা না বলা, মনে কোন দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগ ও উত্তেজনা পোষে না রেখে জীবনকে সহজভাবে দেখা এবং উপযুক্ত বিশ্রাম এ রোগীদের সবসময় প্রয়োজন। প্রয়োজনমতো বিশ্রাম না নিয়ে বেশি দৈহিক বা মানসিক শ্রমের কাজ করা কিছুতেই উচিৎ নয়। ধুমপান ও মাদক-দ্রব্য গ্রহণ অবশ্য বর্জনীয়।

এই রোগে আক্রান্ত হয়ে গেলে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শে থাকা উচিৎ এবং ডাক্তারের নির্দেশানুযায়ী ঔষধ সেবন করাও বাঞ্ছনীয়। এর পাশাপাশি কিছু যৌগিক ব্যায়াম ও মুদ্রা অভ্যাস করলে এই রোগ সহজে নিরাময় হয়।
রোগের প্রকোপ বৃদ্ধি অবস্থায় সকালে ও বিকেলে মুক্তস্থানে পনের মিনিট থেকে আধঘণ্টা ভ্রমণ-প্রাণায়াম অভ্যাসের পর ফিরে এসে শবাসন করতে হবে।
রোগের প্রকোপ কিছুটা কমে এলে সকালে ঘুম থেকে উঠে এক গ্লাস পানি পান করে বস্তিক্রিয়া বা প্রাতঃক্রিয়াদি সেরে কিছুক্ষণ শবাসন করবেন। এরপর বজ্রাসন, অর্ধশলভাসন, যোগমুদ্রা, অর্ধ-চন্দ্রাসনভ্রমণ-প্রাণায়াম করবেন। তবে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যে, উচ্চ-রক্তচাপে আক্রান্ত রোগীর মাথা নিচে করে কোন আসন অভ্যাস করা উচিত নয়। তাঁরা কখনও শীর্ষাসন, শশঙ্গাসন, পদহস্তাসন, হলাসন, মযূরাসন, মৎস্যাসন এবং উড্ডীয়ান ও বিপরীতকরণী মুদ্রা অভ্যাস করবেন না।
রোগ কমে এলে জানুশিরাসন, অর্ধ-কুর্মাসন, অর্ধ-চক্রাসনপদ্মাসন এবং অগ্নিসার ধৌতি যতটুকু সম্ভব হয় করতে পারেন। তবে সঠিকভাবে শবাসনের প্রয়োজনীয় অভ্যাস সবচাইতে কার্যকর প্রক্রিয়া হিসেবে রক্তচাপ রোগীদের জন্য অবশ্যকরণীয় একটি রিলাক্স বা বিশ্রাম প্রক্রিয়া হিসেবে নিয়মিত চর্চায় রাখা উচিত।

(৬.২) নিম্ন-রক্তচাপ
চিকিৎসাশাস্ত্র অনুযায়ী দেহে রক্তের চাপ ১১০ মিলিমিটারের কম হলে তাকে স্বল্প বা নিম্ন-রক্তচাপ বলা হয়।

নিম্ন-রক্তচাপ রোগের লক্ষণ:
রক্তচাপ কমে গেলে আক্রান্ত ব্যক্তির কানের ভিতর সোঁ সোঁ শব্দ হয়, মাঝে মাঝে মাথা ঘোরে, এমনকি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়ে রোগী কিছুক্ষণের জন্য অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারেন। সুনিদ্রা হয় না, বাতে বার বার প্রস্রাবের বেগ হয় এবং ঘুম ভেঙে যায়। বাঁ পাশে কাৎ হয়ে শুতে কষ্ট হয়। কোন কাজে উৎসাহ থাকে না এবং অল্পতেই ধৈর্যহারা হয়ে যান তাঁরা।

রক্তচাপ হ্রাসের কারণ:
শরীর সুরক্ষা ও পুষ্টি বৃদ্ধির জন্য যতোটা প্রোটিন জাতীয় খাদ্য দরকার এবং শরীরের তাপ ও কর্মশক্তি ঠিক রাখার জন্য যতোটা চর্বি ও শর্করা জাতীয় খাদ্যগ্রহণ না হলেই নয়, দীর্ঘকাল ধরে তার চেয়ে কম মাত্রায় গ্রহণ করা এ রোগের অন্যতম প্রধান কারণ। এ ছাড়া প্লীহা, যকৃৎ, ফুসফুস প্রভৃতির দুর্বলতার জন্য দেহে বিশুদ্ধ রক্তের অভাব, অতিরিক্ত মস্তিষ্ক পরিচালনা ও খাটুনি এবং বিশ্রামের অভাব, কখনো কখনো ন্যূনতম কায়িক পরিশ্রমের অভাব ও রক্তবাহী ধমনী-শিরার দুর্বলতাও এ রোগের কারণ হতে পারে।

রোগ নিরাময়ের উপায়:
নিম্ন-রক্তচাপসম্পন্ন রোগীদের জন্যেও একই নিয়ম মেনে চলতে হয়, তবে আহার ও বিশ্রামের দিকে বিশেষভাবে নজর রাখতে হয়। প্রচুর পুষ্টিকর খাবার ও আমিষজাতীয় খাদ্য যেমন মাছ, মাংস, ডিম ও ছানা একান্ত আবশ্যক।
প্রতিদিন প্রাতে ঘুম থেকে উঠে এক বা দু গ্লাস পানি পান করে প্রাতঃক্রিয়াদি সেরে অগ্নিসার অভ্যাসের পর শবাসন, বজ্রাসন, অর্ধশলভাসন, জানুশিরাসন, অর্ধকুর্মাসন, অর্ধ-চক্রাসন, বিপরীতকরণীমুদ্রা সহজভাবে যতটুকু সম্ভব অভ্যাস করা এবং সন্ধ্যায় ভ্রমণ-প্রাণায়াম করলে ধীরে ধীরে এ রোগ সেরে সুস্থ দেহ ও মনে কর্মঠ ও আনন্দময় জীবনযাপন সহজ হয়ে উঠবে।
[Images: from internet]

(চলবে...)

পর্ব: [৯৫][**][৯৭]

No comments: