| ইয়োগা: সুদেহী মনের খোঁজে । ৯৭। নিরাময়: স্নায়ুরোগ ।
রণদীপম বসু
# (০৭) স্নায়ুরোগ (Nervousness/ Nervous-breakdown):
স্নায়ুরোগ বা স্নায়বিক দুর্বলতা একটি মারাত্মক রোগ। এ রোগ সংক্রামক নয় বা এতে রোগীর মৃত্যু না হলেও একে অবহেলা করার কোন উপায় নেই এবং তা উচিতও নয়। কেননা এতে রোগীর আত্মশক্তি ক্রমে ক্ষয় হতে হতে রোগী দিনে দিনে অবশেষে অকর্মণ্য হয়ে যায়।
আমাদের স্নায়ুগুলো অত্যন্ত সুক্ষ্ম রজ্জু বা তারের মতো গোটা দেহে প্রতিটা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে কোষে কোষে জাল-বিস্তার করে ছড়িয়ে আছে। এর মূলকেন্দ্র হচ্ছে আমাদের মস্তিষ্কে। সেখান থেকে সুষুম্নাকাণ্ড বা স্পাইনাল কর্ডের মাধ্যমে বেরিয়ে এসে শাখায়-প্রশাখায় ভাগ হতে হতে গোটা দেহে ছড়িয়ে গেছে। সংবাদ আদান-প্রদান করাই এদের কাজ। মস্তিষ্কের আদেশ-নির্দেশ পরিচালনার মাধ্যমে তা আমাদের দেহযন্ত্রকে চালিত করে থাকে। দেহের ক্ষুধা, তৃষ্ণা, কাম, ক্রোধ, জ্বালা-যন্ত্রণা ইত্যাদি সব ধরনের বৃত্তি, প্রবৃত্তি ও শারীরিক সার্বিক অনুভূতির মূলেই রয়েছে এই স্নায়বিক সঞ্চালন। আর সুস্থ স্নায়বিক সঞ্চালনের উপরে নির্ভর করে আমাদের দৈহিক সুস্থতা এবং সার্বিক কর্মকাণ্ড। এই কাজে স্নায়ুগুলোকে সারাক্ষণই কর্মব্যস্ত থাকতে হয় বলে কেবল রাতে ঘুমের সময় স্নায়ুগুলো বিশ্রামের সুযোগ পায়। তাতে ক্লান্তিমুক্ত হয়ে এরা প্রয়োজনীয় সজীবতা ফিরে পায় এবং আবারো নিজ দায়িত্ব পালনে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করতে পারে। কিন্তু বিশেষ কোন কারণে স্নায়ুগুলো বিশ্রামের অভাবে দুর্বল ও অবসন্ন হয়ে পড়লে বিভিন্ন ধরনের স্নায়বিক জটিলতা এসে ভর করে এবং অদ্ভুত সব রোগের বা উপসর্গের সৃষ্টি করে থাকে। এছাড়াও বিভিন্ন রোগ যেমন অজীর্ণ, অম্ল, রক্তস্বল্পতা, কোষ্ঠবদ্ধতা, অসংযমী কার্য়-কারণ বা বিভিন্ন পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার কারণেও স্নায়ু দুর্বলতা দেখা দিতে পারে।
স্নায়ুরোগের লক্ষণ:
স্মৃতি বিপর্যয়, বুদ্ধিহীনতা, বিকলাঙ্গতা, বলপ্রয়োগে অক্ষমতা, সামান্য কারণে ধৈর্য্যচ্যুতি বা রেগে যাওয়া, মুর্ছা যাওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের জটিলতা দেখা দিতে পারে। যে স্নায়ুজালের বিশেষ ভূমিকার কারণে আমাদের দেহ পরিচালিত হচ্ছে, সেই স্নায়ুজালের একটি মাত্র স্নায়ুর বিপর্যয়ের জন্যে দেহের যেকোন অংশ অকেজো হয়ে যেতে পারে। তাই এ রোগ প্রকাশ পাওয়ার সাথে সাথে কোন ধরনের অবহেলা না করে উপযুক্ত ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। শুরুতেই সতর্ক হলে এ রোগ সহজে নিরাময় সম্ভব।
স্নায়ুরোগের কারণ:
দৈহিক বা মানসিক শ্রম অনুযায়ী দীর্ঘদিন খাদ্য বা বিশ্রামের অভাব, দীর্ঘকালের অতি ব্যায়াম, দীর্ঘদিনের রাত্রি-জাগরণ, অসংযমী জীবন-যাপন, রক্তাল্পতা বা দেহে বিশুদ্ধ রক্তের অভাব, দুশ্চিন্তা বা মনের উদ্বেগ ইচ্ছাকে জোর করে দীর্ঘদিন চেপে রাখা এবং দীর্ঘদিন অন্য কোন রোগভোগ ইত্যাদি এ রোগের কারণ হিসেবে বিবেচিত হয়।
রোগ নিরাময়ের উপায়:
দেহে-মনে স্নায়বিক দুর্বলতা দেখা দিলেই যে কারণের জন্য এ রোগ হয়েছে তা খুঁজে বের করে দ্রুত সেই কারণ প্রতিকারের ব্যবস্থা নিলেই এ রোগ দূর করা সহজ হয়ে যায়। যেহেতু স্নায়ুরোগ নিজে কোন রোগ নয়, মূলত অন্য কোন রোগ বা কারণের উপজাত, তাই স্নায়ুরোগের উৎস-কারণের লক্ষণগুলো পর্যবেক্ষণ করে সে অনুযায়ী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়াই হচ্ছে এ রোগ নিরাময়ের সঠিক উপায়। অতিরিক্ত কায়িক শ্রমের কারণে এ রোগ হলে পরিমিত পুষ্টিকর আহার ও কয়েকদিন প্রয়োজনীয় পূর্ণ বিশ্রাম নিলে এ রোগ থেকে মুক্ত হওয়া যায়। আবার যদি রক্তাল্পতা বা বিশুদ্ধ রক্তের অভাবের জন্য এ রোগ হয়ে থাকে, তাহলে রোগীর মধ্যে অম্ল বা অজীর্ণ বা কোষ্ঠকাঠিন্য কিংবা তারল্য রোগের লক্ষণ দেখা যাবে। সে ক্ষেত্রে সেই রোগ অনুযায়ী ব্যবস্থা নিলেই সেই রোগ দূর হওয়ার পাশাপাশি স্নায়বিক দুর্বলতাও কেটে যাবে। পরিমিত পুষ্টিকর সহজপাচ্য খাদ্যগ্রহণ ও সকালে ঘুম থেকে উঠে এক-দু’গ্লাস পানি পান করে পবন-মুক্তাসন, বিপরীতকরণী মুদ্রা, অর্ধ-কুর্মাসন ও পদ-হস্তাসন অভ্যাস করতে হবে। এরপর জলখাবারের আধঘণ্টা পর জানুশিরাসন, অর্ধ-চক্রাসন, সর্বাঙ্গাসন ও মৎস্যাসন করতে হবে। বিকেলে মুক্তস্থানে ভ্রমণ-প্রাণায়াম, রাতে শয্যাগ্রহণের পূর্বে দশ মিনিট বজ্রাসন অভ্যাস এবং সপ্তাহে একদিন পূর্ণ উপবাস করলে এ রোগ হতে নিরাময় পাওয়া যাবে। যদি দীর্ঘদিনের চেপে রাখা অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগের কারণে এ রোগ হয়ে থাকে, তাহলে রোগীর মধ্যে উচ্চ-রক্তচাপ বা অম্লের লক্ষণ প্রকাশ পাবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। এভাবে উৎস-রোগের প্রয়োজন অনুযায়ী প্রতিকারের ব্যবস্থার মাধ্যমে স্নায়ুরোগ দূর করার ব্যবস্থা না নিলে এ রোগ একসময় পুরোপুরি স্নায়ুবৈকল্যে রূপ নেয়াও অসম্ভব নয়। সর্বক্ষেত্রে রিলাক্সেশন বা শিথিলায়নের অন্যতম সর্বোত্তম প্রক্রিয়া হিসেবে যথাযথ শবাসন অভ্যাস অনেক জটিলতার নিরসন করতে সক্ষম বলে যোগশাস্ত্রীরা মনে করে থাকেন। তবে এটা মনে রাখতে হবে যে, স্নায়বিক দুর্বলতা দূর করার প্রধান শক্তিই হচ্ছে মনের শক্তি। ধৈর্য্য ও নিরবচ্ছিন্ন আন্তরিক প্রচেষ্টা ও উদ্যমের মাধ্যমে অনায়াসে এসব রোগ থেকে সফলভাবে মুক্তি পাওয়া সম্ভব।
[Images: from internet](চলবে...)
পর্ব: [৯৬][**][৯৮]
No comments:
Post a Comment