Thursday, December 4, 2008

[Yoga] ইয়োগা: সুদেহী মনের খোঁজে । ০১ । ভণিতা














ইয়োগা: সুদেহী মনের খোঁজে । ০১ । ভণিতা
রণদীপম বসু

চোখ ফেরালেই ইদানিং সুদেহী মানুষের অভাববোধ ভয়ানক পীড়া দিয়ে উঠে। তারচে’ও প্রকট সুস্থ দেহে সুমনা সত্ত্বার অভাব। আমরা কি দিন দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছি ! সর্বগ্রাসী দুষণের মাত্রাতিরিক্ত সংক্রমণে মানুষের শরীর স্বাস্থ্য ঠিক রাখা বাস্তবিকই কঠিন আজ। এ বড় দুঃসহ কাল। শরীরের সাথে মনের যে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক, তার সূত্র ধরেই নাগরিক সভ্যতায় আজ দিনকে দিন সামাজিক নিরাপত্তাহীনতার সাথে পাল্লা দিয়ে একদিকে যেমন বেড়ে চলছে মানসিক অস্থিরতা, টেনশন আর অনিশ্চয়তা, অন্যদিকে অতিদ্রুত ভেঙে পড়ছে সতেজ মনে সুস্থ থাকার ন্যুনতম ভারসাম্যতাও। এই কঠিন দুঃসময়ে নিজের দিকে একটু ফিরে তাকানোর সময়ও কি হবে না আমাদের !

শহর বন্দর গ্রাম গঞ্জ থেকে একে একে বিলীন হয়ে যাচ্ছে চোখে নিবিড় আদর বুলানো সবুজ বৃক্ষ, বুক ভরে শ্বাস নেয়ার নির্মল বাতাস, বিশুদ্ধ পানীয় জলের স্বচ্ছতা, খেলার মাঠ আর আকাশের উদারতা এবং সুস্থ দেহে বেঁচে থাকার অনিবার্য শর্তগুলো। আমাদের অজান্তেই আমরা যে কতো নীরব ঘাতকের চিহ্ণিত লক্ষ্য হয়ে যাচ্ছি সে খেয়াল কি রাখছি ? সৃজনশীল হওয়া সে তো বহু দূরের কথা। অথর্ব মন আর ভাঙা শরীর নিয়ে এতো সহজ মৃত্যুর দিকে জটিল সব অসুখের ডিপো হয়ে তিলে তিলে ভোগে ভোগে যেভাবে আণ্ডাবাচ্চাসহ এগিয়ে যাচ্ছি আমরা, সামনে এখন দুটো পথই খোলা। সব কিছু মেনে নিয়ে বাধ্য প্রাণীর মতো একযোগে আত্মহত্যা করা, নয়তো ঘুরে দাঁড়ানো। যিনি আত্মহত্যা করার মৌলিক অধিকারের ঝাণ্ডা উড়িয়ে মার্চপাস্ট করবেন, তাঁর সাথে তো আর কোন হিসাব চুকানোর কিছু নেই। যিনি তাঁর মানবিক সৃজনশীলতাকে অর্থবহ বাঁচিয়ে রাখার জন্যই ঘুরে দাঁড়াতে চান, আসুন আমরা সে চেষ্টাটাই করে দেখি একবার।

ভুলে যাওয়া স্মৃতিকথা
সেই ছোটবেলায় তোতাপাখির মতো বহুবার মুখস্থ করেছি আমরা, সুস্থ দেহ সুস্থ মনের ঘর। আরো অনেক আপ্তবাক্যের মতোই প্রাথমিক বিস্ময় নিয়ে কথাগুলো হয়তো ঠোটস্থও করেছি। কিন্তু উপলব্ধিতে এসেছে কি ? উঁহু, আসে নি। কখনোই আমরা উপলব্ধি করি নি তা। এখনও করি না। যে যতো বড়ো মাপের পণ্ডিত আর বুদ্ধিজীবী মহাজ্ঞানীই হই, বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, জগতের এতো জটিল জটিল সমস্যা সম্ভাবনা আর ঘটনাবলী নিয়ে যতটুকু ভেবে ভেবে অস্থির হয়ে উঠি আমরা, এর শতাংশও কি নিজের এই দেহবাড়িটা নিয়ে ভাবি কখনো ? নগন্য যে ব্যতিক্রম রয়েছেন তাঁদের প্রতি যথাযথ সম্মান রেখেই বলছি, আমরা ভাবি তখনই যখন নিরূপায় হয়ে চোখে অন্ধকার দেখতে থাকি। কথায় বলে না, গরু কি আর সাধে গাছে চড়ে ! যে বলে গরু গাছে চড়ে না, সে ভুল বলে ! আমরা যে গরুকে গাছে চড়তে দেখি না তার কারণ হচ্ছে, যে নিরূপায় সময়টাতে এসে গরুর গাছে চড়ার অবস্থা তৈরি হয়, তখন আর গাছে চড়ার মতো সুযোগও তার থাকে না। আমরা অন্তত গাছে চড়ার সুযোগটা নিতে চাই। আর গাছে চড়তে হলে আমাদেরকে আবার আমাদের সেই প্রাচীন ঐতিহ্যের দিকেই ফিরে তাকাতে হবে। এবং ঐতিহ্যের দিকে তাকাবো তো বটেই। তবে তার আগে কয়েকটা অতিরিক্ত কথাও বলা নেয়া দরকার।

ছোটবেলায় শেখা কথাটা আবার একটু আউড়াই ? সুস্থ দেহ সুস্থ মনের ঘর। প্রাথমিক বিস্ময় নিয়ে ভাবতাম এই দেহটা যদি ঘর হয় মনটা তো এই ঘরের মধ্যেই থাকে। আর তার অবস্থানটাও মোটামুটি পাকা করে ফেলেছি, নিশ্চয়ই তা এই বুকের তলে, ভিতরেই। যেখানে সারাক্ষণ একটা ধুকপুক ধুকপুক চলতেই থাকে। ছোটাছুটি করে এলে ধুকপুকানি বেড়ে যায় আরো। কোথাও ভয় পেলে ধক্ করে উঠা বুকে মা দাদিরা কতো দরদ দিয়ে মালিশ করে দিতেন মনটাকে শান্ত করার জন্য। হরিণিচঞ্চলা প্রেয়সীর দিকে এই বুকটাকেই তো উজার করে ঢেলে দিতে যাই আমরা এখনও। কেননা এই বুকের গভীরেই তো মমতায় প্রণয়ে লেপ্টে থাকে দুরন্ত মনটা। আহা, আরেকটু পড়াশুনা করে কী সর্বনাশটাই না হয়ে গেলো ! হারিয়ে ফেললাম মনটা। যখন সত্যি সত্যি জেনে গেলাম, মনতো বুকে থাকে না, থাকে মাথায়, খুলির ভিতরে, মস্তিষ্কে ! এখন মনটাকে কোলে তুলে দিতে গিয়ে ষাঁড়ের মতো মাথা দিয়ে গুঁতোই দিতে বসেছিলাম বালিকার পেটে। কী কেলেঙ্কারী হয়ে যেতো ! ভাগ্যিস তা করিনি। কারণ এর পরে এটাও জেনে গেলাম যে মন বলতে আসলে ধরাছোঁয়ার মতো কিছুই নেই। স্রেফ একটা মানবিক চেতনা মাত্র। অর্থাৎ এই শরীরেরই এক মহাবিস্ময়কর কারসাজি !

শরীর ধরো শরীর ভজ শরীর করো নিশানা। লোকায়ত ঘরাণার সহজিয়া সুরগুলো হঠাৎ করেই বেশ অর্থবহ হয়ে বুকের মধ্যে ধাক্কা দিতে শুরু করলো। আহা, প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষাহীন বাংলার এই বাউলরা জানলো কী করে যে শরীরই সব কিছুর মূল ! ইতোমধ্যে পুরোদমে শরীরচর্চার ছাত্র বনে গেছি। খুব ভোরে উঠে রীতিমতো দৌঁড় আর দৌঁড়। তারপরে বিভিন্ন ধরনের শারীরিক কসরত মানে ফ্রি-হ্যান্ড এক্সারসাইজ। আর পারি কি না পারি, নাগালের মধ্যে যতধরনের লম্ফ-ঝম্প খেলাধূলার সুযোগ পাচ্ছি সবতাতেই আমি হাজির। শরীরটাও দেখি হঠাৎ করে শেপ ধরতে শুরু করেছে। আর অকস্মাৎ এটাও আবিষ্কার করছি যে চোখের সামনে দিয়ে বড় হয়ে উঠা মেয়েগুলো সাংঘাতিক রূপসী আর আমার মতোই বড় বেশি শরীর সচেতন হয়ে উঠছে এবং আমার আশেপাশেই একটু বেশি বেশি ঘুরাঘুরি করছে। কিন্তু যতটুকু জানি তারা তো আমার মতো এতটুকু শিক্ষাগ্রহণের কাজ এখনো সম্পন্ন করে উঠতে পারে নি। তাহলে শরীর বিষয়ক এতো সচেতন হলো কী করে ? বালিকা যেইটাই কাছে আসে, তাদের সচেতনতায় অত্যন্ত প্রীতভাব দেখিয়ে জ্ঞানীর মতো বলি, দেখো, মন বলে আসলে কিচ্ছু নেই ! শরীরই আসল, শরীরই সব। ঐযে লালনের গান শুনো নাই- শরীর ধরো শরীর ভজ শরীর করো নিশানা ? দেহতত্ত্বের এতো ভারী ভারী কথা তখনও তাদের বুঝার অগম্য বলেই কিনা কে জানে, অদ্ভুতভাবে আমার দিকে একবার তাকিয়ে সেই যে ভোঁ দৌঁড় দেয় আর কখনোই কাছে ভীড়ে না ! এরপর থেকে দেখি কোন মেয়ে আমাকে দেখলেই ভীতচোখে বিশহাত তফাতে থেকেই দৌঁড়ে পালায়।

স্থান পরিবর্তনের কারণে যখন আর দৌঁড়াদৌঁড়ির সুযোগ রইলো না, তখনই বিকেলে বিকেলে শুরু হলো বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ জিমন্যাসিয়ামে যাতায়াত। ভেতরেই শরীরটাকে ওয়ার্ম-আপ করে ফ্রি হ্যান্ড এক্সারসাইজের পাশাপাশি জিমের চেনা অচেনা অ্যাপারেটাসগুলো নাড়াচাড়া। ওখানে ছাত্র দুয়েকজন গেলেও অধিকাংশই প্রাক্তন ব্যায়ামবিদ ছাত্রদেরই আনাগোনা বেশি ছিলো। একেকজনের কী পেশীবহুল পেটানো শরীর ! কেউ বডিবিল্ডার, কেউ বক্সার, কেউ সৌখিন শরীরচর্চাকারী। অনেকের সাথেই সখ্যতা গড়ে উঠে। এই সখ্যতার বদান্যতায় সিনিয়র এক বডিবিল্ডার ভাই পরামর্শ দিলেন, দেখো, যদি একবার এপারেটাস নির্ভর হয়ে উঠো তখন আর তা চর্চা না করলে শরীর ঠিক রাখতে পারবে না। ফুলে যাবে এবং হিতে বিপরীত হয়ে উঠবে। তিনি নিজের এই ফাঁটা বাঁশে আটকে যাওয়ার উদাহরণ দিয়ে নমুনা হিসেবে যাঁর কথা উত্থাপন করলেন, তা শুনেই ভড়কে গেলাম আমি। অটল দা। কুমিল্লা লিবার্টি সিনেমা হলের মালিকের ছোট ভাই। খুব ভালো করে চিনি। মানুষের বিশাল শরীরে কতো ধরনের পেশী আর কার কী রূপ ও ক্ষমতা তা সামনাসামনি যাকে দেখে মুগ্ধ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থেকেছি একসময়, তিনিই অটল দা। শারীরিক শক্তি যে কী দুর্দান্ত হতে পারে তাও তাকে দেখে বুঝেছি। হয়তো মিঃ বাংলাদেশ প্রতিযোগিতার যোগ্য প্রতিদ্বন্দ্বি হিসেবেই প্রস্তুত ছিলেন তিনি। সকাল বিকাল দিনে দুবার তিন ঘণ্টা করে ভারোত্তোলনসহ শরীর চর্চা করতেন ভিক্টোরিয়া কলেজ জিমন্যাসিয়ামে। সরকারের সাথে দীর্ঘদিনের মামলার রায়ে লিবার্টি হলের মালিকানা হাতছাড়া হয়ে গেলে জীবিকার টানাপোড়েনে জিমে আর নিয়মিত হতে না পারায় সেই অটল দা’রই পরবর্তী শারীরিক স্ফীতি দেখে পুরাপুরি ভচকে গিয়েছিলাম। এতো বিশাল পেশীবহুল শরীরটা অল্প কিছুদিনের মধ্যেই মেদচর্বির আধিক্যে যেভাবে ফুলে উঠছিলো, অটল দা’র মানসিক অবস্থা কেমন ছিলো তা আঁচ করা গেলেও আমার তো হতবাক কান্নাই উঠে এসেছিলো। আমার সেই সিনিয়র ভাইটি আরেকটি ভয়ঙ্কর কথাও মুখ ফসকে বলে ফেলেছিলেন। অটল দা’র মতো অবস্থায় পড়ে আরেকজনকে তিনি বড্ড অকালেই শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত হার্টস্টোক করতে দেখেছেন। এখনো সেই ভাইটির প্রতি আমার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। খুব সময়কালেই প্রয়োজনীয় একটা পরামর্শ দিয়েছিলেন বলে। হয়তো কোন বডিবিল্ডার বা ব্যায়ামবিদও হইনি। কিন্তু নিজের শরীর নিজেরই বোঝা হয়ে উঠার মতো দুর্ভাগ্যে পা দিতে হয়নি আমাকে তাই।

ভার্সিটিতে ঢুকেই খোলা মাঠ সবুজ বনানী আর উদাত্ত আকাশ পেয়ে ফের দৌঁড়ঝাঁপের সুযোগ তৈরি হলো। এতে জড়িয়ে গেলাম ঠিকই। তবে এবার দীর্ঘদিন ভেতরে ভেতরে পুষে রাখা ইচ্ছাটাকে উন্মুক্ত করার সুযোগ পেয়ে ভর্তি হয়ে গেলাম মার্শাল আর্ট ট্রেনিং-এ। এতোদিন এটাকেই কখনো ভাবতাম ক্যারাটে, কখনো ভাবতাম কুং ফু, কখনো ভাবতাম জুডু বা কখনো জুজুৎসু ইত্যাদি ইত্যাদি। আসলে এই চায়না জাপানি বা ভিন্নভাষী নাম সবগুলো মিলিয়েই সম্মিলিত নাম হচ্ছে ইংরেজি মার্শাল আর্ট। একেকটার বিশেষত্ব একেক। তবু কিছু কমন বিষয় তো ছিলোই। সবগুলোরই বেসিকটা ছিলো একই। এবং এখানে সংশ্লিষ্ট হয়েই শরীরচর্চা বিষয়ক ধারণাটাও ধাক্কা খেলো দারুণভাবে। মূলত এখানেই আমার শরীর বা শরীর ঠিক রাখার উপায় বিষয়ক আপাত স্পষ্ট ধারণাগুলো তৈরি হতে লাগলো একটু একটু করে। যদিও দুর্ভাগ্যজনকভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিস্থিতি রাতারাতি পাল্টে যাবার কারণে তীব্র ইচ্ছা থাকা সত্তেও আমার এই পাঠ শেষপর্যন্ত সফল সমাপ্তির মুখ দেখেনি, তবু যেটুকু ধারণা পেয়েছি তা-ই পরবর্তী জীবনে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছে আমার । এবং এখনও হচ্ছে। আর এখানেই অত্যাবশ্যকীয় চর্চার অনিবার্য মাধ্যম হিসেবে ইয়োগা বা যোগব্যায়ামের সন্মোহনীক্ষমতা ও কার্যকরিতার বিষয়টা উপলব্ধি করে সেই অকৃত্রিম অনাবিল বন্ধুটির খোঁজ পেয়ে গেলাম, যা আমাকে আমৃত্যু সঙ্গ দিয়ে যাবার সংশয়হীন যোগ্যতা রাখে বলে আমি বিশ্বাস করতে লাগলাম। এবং তা আমি এখনো বিশ্বাস করি।

(চলবে...)

পর্ব: [**][০২]
...
[sachalayatan]
[somewherein]
...

No comments: